• বরিশাল বিভাগ

    দাদনের ইন্দ্রোজালে দক্ষিনাঞ্চলের গোটা জেলে পরিবার

      প্রতিনিধি ৬ অক্টোবর ২০২২ , ১২:১৯:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ

    মু,হেলাল আহম্মেদ রিপন-পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ

    পাগলা ঢেউয়ের মরন থাবা উপেক্ষা করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যারা,যুগ যুগ ধরে সেই জেলে পরিবারগুলো আজ দাদন প্রথার ইন্দ্রোজালে জিম্মি। পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বীরের বেশে চুটে চলছে গভীর সাগরে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছাড়াও অযাচিত জলদস্যূদের নির্মম অত্যাচার যনো নিত্যসঙ্গী। হাজারো প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে কেমন চলছে এই দাসত্বের দাদন খাটাজেলে সম্প্রদায়ের জীবন প্রনালী।

    ৩০ বৎসরের অধিক সময় এই পেশায় নিয়োজিত পটুয়াখালী রাঙ্গাবালী উপজেলার বাহেরচর ইউনিয়নের শ্রী বাবুল চন্দ্র দাস বলেন, দাসত্ব দাদনের বেড়া জালে আঁটকে পড়েছে আমার জীবন। ইচ্ছে থাকলেও বেরুতে পারছিনা দাসত্ব দাদনে শিকল ছিড়ে। সাগরের পাগলা ঢেউ থেকে নিস্তার পেলেও দাদন প্রভুদের শিকল থেকে নিস্তার নেই। গত ৩০ বৎসরে হারিয়েছি অনেক সহকর্মীকে। মরা মাছের মূল্য আছে কিন্তু হতদরিদ্র জেলেদের কোন মুল্য নেই। জেলে বাবুল চন্দ্র দাস আরো বলেন, মা ইলিশের প্রজনন কালীন সময়ে ৬৫ দিনের সরকারি অবরোধ চলে।

    এসময় সরকার বাহাদুর জেলেদের মাঝে চাল বিতরন করলেও আমার মতো অসংখ্য জেলে পরিবার এখন পর্যন্ত একমুঠো চাল পায়নি। তাহলে এই নিষেধাজ্ঞার মানে কি। কোথায় যায় এসব চাল। সরেজমিন অনুসন্ধানেগেলে দেখা যায়, প্রায় ৯০℅ শতাংশ জেলে হতদরিদ্র। নিজেদের নৌকা বা জাল কেনার সামর্থনেই । কাজ করেন দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে। সবসময় নৌকার মালিক কিম্বা মহাজনের কাছ থেকে আগাম দাদন নিয়ে থাকে। তাছাড়া মালিকের সঙ্গে জেলেদের কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র থাকে না। নেই কোন ঝুঁকি ভাতা। শুধু শ্রম বিক্রি করে দাদনের বিনিময়ে। যার ফলে মহাজনের কাছে জিম্মি থাকতে হয় বছরের পর বছর।

    এবিষয়ে মহিপুর,আলীপুর, কুুুয়াকাটা মৎস ব্যবসায়ীদের সভাপতি,দিদারুল আলম মাসুম বেপারী দৈনিক বরিশাল সমাচারকে বলেন,মহিপুর মৎস্য ব্যবসায়ীরা ভালো নেই, আমরা সরকারি কোন সুুুযোগ সুবিধা পাইনা। নিজেদের অর্থায়নে সব করতে হয়। এ অঞ্চলে দেড় থেকে দু হাজার মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে,জেলেরাও ভাল নেই। এর পর কতো অবরোধ নিয়ম কানুন,সবমিলিয়ে আমাদের দেখতে হয় জেলেদের।একটি কথা না বললেই নয় পার্শবতী দেশ ভারত বাংলাদেশে ৬৫ দিনের অবরোধের সময় ব্যপক পরিমান মাছ ধরে নিয়ে যায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের জেলেরা। যদি একই সময় উভয় দেশে অবরোধ পালিত হয় তাহলে আমাদের দেশের জেলারা লাভবান হবে পাশাপাশি দেশের মৎস খাতেও লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।

    মৎস্য খাতে দাদন প্রথা বন্ধের তাগিদ জেলে ও সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরের শ্রমিকদের অবস্থা বিষয়ক আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিবেদনে মৎস্য খাতে দাসত্বের দাদন (শর্তযুক্ত ঋণ) প্রথা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এ ছাড়া সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরের বৈশি^ক ভ্যালু চেইনে ন্যায্যমূল্য ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত, অন্যায্য ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও আইনের ব্যবহার নিশ্চিত, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী বা জেলে ও শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ এবং লাভ জনক ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা ও মূল্য সহায়তা প্রদানের সুপারিশও করা হয়েছে বলে জানাযায়।

    মৎসকর্মকর্তা, মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত তালিকায় জেলেদের ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত সরকারের নীতি অনুযায়ী মাছ ধরার সময় কোন জেলে নিখোঁজ হলে কিংবা মারা গেলে তার পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য সর্বোচ্চ এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে; যা যথেষ্ট নয়। আবার সেই বিধান পুরোপুরি কার্যকরও নয়।

    উন্নয়ন কর্মী, মো,মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারের সংখ্যা তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ওইসব ট্রলার বে-আইনিভাবে সাগরে মৎস্য আহরণ করছে; যা শুধু সামুদ্রিক বাস্তু সংস্থানেরই ক্ষতি করছে না, প্রচলিত পদ্ধতিতে মৎস্য আহরণকারী জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

    শুধু গাইবান্ধায় কিংবা চাদঁপুর নয়, দেশের আরও বহু স্থানে কারেন্ট জাল উৎপাদন ও চোরাইভাবে বিক্রি হচ্ছে। সেসব জাল দিয়ে জেলেরা মাছ ধরছেন। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারেন্ট জাল আটক এবং সংশ্লিষ্ট জেলেদের মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানার খবর আমরা শুনতে পাই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ক্ষেত্রে যে খামখেয়ালি রয়েছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু এ রকম তো চলতে পারে না। দেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষা করতে হলে অবশ্যই এই জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারেন্ট জাল উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

    পাশাপাশি জেলেসমাজের মধ্যে বৈধ জাল ব্যবহার করে জীবিকা উপার্জনের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তাঁদের জালে মা মাছ, পোনা বা জাটকা ধরা পড়লেও যাতে তাঁরা সেগুলো পরে জলাশয়ে ছেড়ে দেন, সে ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।আমাদের মানবদেহে আমিষের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হয় মাছ থেকে। তাই মৎস্য সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং উৎপাদন না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই। মত্স্য খাতের ভবিষ্যতের স্বার্থেই কারেন্ট জাল,বেনতিজাল সহ যেসব জাল ব্যবহার বন্ধ করে দেয়াটাই অতীব জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরকে নিয়মিত অভিযান ও প্রচার-প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ