• চট্টগ্রাম বিভাগ

    বর্তমানে ডিভোর্স মহামারি

      প্রতিনিধি ৮ জুলাই ২০২৩ , ৬:৪৪:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    মাহফুজুর রহমান-সূবর্ণচর নোয়াখালী:

    বর্তমান সমাজে ডিভোর্স একটি মারত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই; পান থেকে চুন খসলেই অনেক মেয়েরা পাঠিয়ে দেয় ডিভোর্স লেটার। সমাজের স্রোত যে এখন কোন দিকে গড়াচ্ছে তা বলাই মুশকিল! আপনি শুনলে চমকে উঠবেন, বর্তমানে ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় একটি করে ডিভোর্সের আবেদন হচ্ছে। যেখানে ২০১২ সালে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনের পরিসংখ্যান মতে ডিভোর্স হয়েছিল ৭৪০২টি সেখানে ২০১৭ সালে ডিভোর্সের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০,২৯১টি। আর এখন তো ২০২২/২৩ সাল! শুধু ঢাকা শহরই নয়, ডিভোর্সের প্রবণতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসের মতো। বিবিএস এর তথ্যমতে গত ৭ বছরে সারা দেশের ডিভোর্সের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। আর এই ডিভোর্সের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় শিক্ষিত নারী-পুরুষের মধ্যে। তবে নারী-পুরুষের পরিসংখ্যান হিসেবে বেশ এগিয়ে আছে নারীরাই। ৭০% নারীদের বিপরীতে ৩০% পুরুষ ডিভোর্স দিয়ে থাকে। 

    বিচ্ছেদ’ শব্দটি অতীব কষ্টের। যে কোনো বিচ্ছেদই পীড়াদায়ক। হোক তা বন্ধুত্বের কিংবা বৈবাহিক বন্ধনের। কিন্তু সমাজে বিচ্ছেদের প্রবণতা কেন বাড়ছে? এটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন, তা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব।

    বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা, সন্দেহপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা, পর্দা-পুশিদা রক্ষা করা, পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা, যৌতুকবিহীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শারীরিকভাবে অক্ষম হলে বিবাহ থেকে বিরত থাকা—এ সবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানা হয় না বিধায় প্রতিনিয়ত বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। ডিভোর্সের ফলে দুজনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্য জীবনগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। এটা সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়, যা মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক।

    ইসলামে ডিভোর্সের প্রতি নানাভাবে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদের কড়া সমালোচনা করেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।’ সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০১৮। হজরত মুহারিব ইবনে দিছার রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে অন্য এক হাদিসে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা তার কাছে তালাকের চেয়ে অপ্রিয় কোনো কিছু হালাল করেননি।’ সুনানে আবু দাউদ: ২১৭৭। অন্যদিকে যে নারী বিনা কারণে তালাক চায়, তার  ব্যাপারে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে—যে নারী তার স্বামীর কাছে বিনা কারণে তালাক প্রার্থনা করে, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস:২০৫৫।

    শরিয়তের নির্দেশনা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিলে নিজেরাই মিটমাট করে নেবে। যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা হয়, তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। ইরশাদ হয়েছে, তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত। সুরা নিসা (৪) :৩৫

    আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহ তাআলা তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দেবেন। কাজেই বিবাহবিচ্ছেদের আগে এই কুরআনি শিক্ষা অনুসরণ করা কাম্য। শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, জীবনে মা-বাবা, ভাইবোন, সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—কত জনেরই তো কত কিছু মেনে নিই আমরা। সংসারজীবনেও দুই পক্ষের জন্যই এই মানিয়ে চলাটা জরুরি। এটা মানতে পারলেই বিবাহিত জীবন সুখের ও স্বাচ্ছন্দ্যের হবে।

    দাম্পত্য জীবন মধুময় করে তুলতে এবং এক জন দায়িত্বশীল ও সফল স্বামীরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমরা বুজুর্গদের নিম্নোক্ত পরামর্শ মেনে চলতে পারি : ১. স্ত্রীকে উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া। বাড়ির লোকজনের আচরণ ও রুচির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে ন্যূনতম সময়টা দিতে হবে। ২. স্ত্রীর গুণের মূল্যায়ন করা। ৩. স্ত্রীর ছোটখাটো ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া। নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের অপছন্দের কিছু করতে দেখলে চুপ থাকতেন। ৪. দেখা হওয়ামাত্রই সব সময় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসা। ৫. সাংসারিক ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনের জন্য স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা। যোগ্যতা অনুযায়ী তার মেধা ও মননের স্বীকৃতি দেওয়া। ৬. গৃহস্থালীয় কাজে বিশেষত ছুটির দিনে স্ত্রীকে সহযোগিতা করা। ৭. স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ও ভদ্রোচিত আচরণ করা। নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানুষ সে, যে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করে। আমি আমার স্ত্রীদের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করি।’ সব সময় মনে রাখবেন, স্ত্রীর সঙ্গে যা-ই করছেন, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে মহান রব আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে। ৮. একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের সময় স্ত্রীর ইচ্ছাকেও প্রাধান্য দেওয়া। ৯. স্ত্রীর জন্য সামর্থ্যানুযায়ী ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। ইসলামে তো ডিভোর্স দেওয়ার সময়ও নারীকে গিফট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজেই, থাকাকালীন যে মাঝেমধ্যে গিফট দিয়ে তাকে সারপ্রাইজড করবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১০, জীবনসঙ্গীর জন্য সুন্দর একটা নাম নির্বাচন করা। কখনো তাকে কোনো বাজে নামে বা মন্দ শব্দে ডাকা যাবে না। আল্লাহর নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের এমন নামে ডাকতেন, যে নামে ডাকাটা তারা খুবই পছন্দ করতেন।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ