• গণমাধ্যম

    শিশু সাংবাদিকতা কার জন্য, কি!

      প্রতিনিধি ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৫:২০:৪১ প্রিন্ট সংস্করণ

    আলোকিত ডেস্কঃ

    সাম্প্র্রতিক সময়ে সমুদ্রপাড়ে পড়ে থাকা শিশু আইলানের মৃতদেহের ছবি পত্রিকায় ছাপানো বা টিভিতে প্রচার এবং সামাজিক গণমাধ্যমে আপলোড করা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক তৈরি হয়। নিজের দেশে জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় মা-বাবা তাঁদের শিশুসন্তানসহ বেঁচে থাকার আশায় অজানা পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। সংবাদটি প্রকাশ করলেও বাংলাদেশসহ বহু দেশের মিডিয়া ছবিটি প্রকাশ ও প্রচার করেনি। ঢাকায় নীতিগতভাবে ছবিটি প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়েছে কেউ কেউ, আবার কেউ কেউ তা প্রকাশ করেছে। প্রকাশ না করার যুক্তি ছিল, এ ছবি পাঠকের মনে বিশেষ করে শিশুদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

    প্রকাশের পক্ষে বলা হয়েছে সত্য যতই নির্মম হোক, তা অবলোকন করা হলে এর বিপক্ষে মতামত জোরালো হবে। এ বিষয়গুলো বিতর্কের মধ্যেই থাকে। এ নিয়ে জনস্বার্থে মামলা হতে পারে। তবে মামলা করা বা আদালতের রায় নেওয়াটাই একমাত্র সমাধান নয়। মানুষকেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধানে আসা প্রয়োজন।শিশু সাংবাদিকতার কিছু নীতিমালার কথা আবার বলার জন্য এ সপ্তাহে আয়োজিত এক সেমিনারে শিশুদের অংশগ্রহণ নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়নি। ধরে নিচ্ছি এ প্রসঙ্গটি এখানে গুরুত্ব পায়নি। তবে ১৫ বছর আগে শিশু সাংবাদিকতায় শিশুদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য মুক্ত সাংবাদিকতা শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল একুশে টিভিতে।

    ইউনিসেফ অর্থায়ন করেছিল অনুষ্ঠানটির। এখানে সিনিয়র প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে শিশুরা সংবাদ সংগ্রহ করে তা সম্পাদনা করেছে। এর একটা উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকতায় নতুন প্রজন্মকে একেবারে মানসিক প্রবৃত্তির ভিত্তি পাওয়ার বয়স থেকে গড়ে তোলা। কিন্তু একটা সময় পর অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি শুরু করলেও এর কোনো যৌক্তিক পরিণতির চেষ্টা করেনি জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটি। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রায়োরিটি হয়তো বদলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিসেফ সাংবাদিকদের জন্য ‘শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালা’ নামে একটি নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করেছে। শিশুদের বিষয়ে রিপোর্ট বা ফিচার করতে গেলে কোন বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়া প্রয়োজন।

    কোনটি বাদ দিতে হবে সেসব উল্লেখ করা হয়েছে এ নীতিমালায়। এ নীতিমালার মোড়ক উন্মোচনের সময় তথ্যমন্ত্রী সত্য খোঁজা ও প্রকাশের পাশাপাশি জনস্বার্থ, দেশের নিরাপত্তা ও নারী-শিশুর স্বার্থ দেখাও গণমাধ্যমের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন (২৬ অক্টোবর ২০১৫)। অর্থাৎ তিনিও শিশু সাংবাদিকতাকে শিশুর স্বার্থের আলোকে দেখার ওপর জোর দিয়েছেন। ইউনিসেফ ২০০৫ সালে এ ধরনের আরো একটি হ্যান্ডবুক প্রকাশে সহায়তা করেছিল। ‘শিশু অধিকার ও গণমাধ্যম’ নামের সেই হ্যান্ডবুকের লক্ষ্য ছিল ‘শিশু অধিকার বিষয়ে সাংবাদিকদের ধারণা বৃদ্ধি করা এবং কিভাবে এ নিয়ে মুদ্রণ মাধ্যম ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংবাদ ও ফিচার রচনা করা যায়, তার দিকনির্দেশনা’ দেওয়া।

    সেখানেও অনেক নীতি-নৈতিকতার কথা পেয়েছি। সেই হ্যান্ডবুকে নীতিমালা ও নীতিমালার প্রয়োগ সম্পর্কে গাইডলাইন দিতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস নির্ধারিত শিশুবিষয়ক সংবাদ তৈরির নীতি-সম্পর্কিত নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিশু সাংবাদিকতার বিষয়ে ইউনিসেফের এ সচেতনতা সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। তবে এর জন্য মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব পলিসি থাকা জরুরি এবং তা বাস্তবায়নে তাদের আন্তরিকতাও থাকতে হবে।আমাদের দেশে প্রায় নিয়মিত শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট, ফিচার থাকে মিডিয়ায়। একদিকে শিশু রাজন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। তিন বছরের শিশুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, মায়ের কোলে করে সে শিশু আদালতে হাজিরা দেয়। চুরির অভিযোগে শিশুকে অভুক্ত রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়। এসব খবর ও ছবি আমরা দেখি মিডিয়ায়।

    পাশাপাশি তাদের সাফল্যের বিষয়ও আসে মিডিয়ায়। সিলেটের মনি বেগম নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে শিশুর অধিকার নিয়ে কথা বলেন। সে খবর ও ছবি আমরা মিডিয়ায় পাই। এসব দেখে, পড়ে আমরা কখনো বিমর্ষ হই, কখনো গর্ব অনুভব করি। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে মিডিয়া। ভূমিকা পালনের কারণেই দায়িত্ব ও নীতিমালার প্রসঙ্গটি এসে যায়।আমরা যে শিশু সাংবাদিকতার কথা বলছি, সেটি আসলে কার জন্য। এটা কে করবে? এর লক্ষ্য কী এবং কে? এর সঙ্গে শিশুরা কতটা যুক্ত হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বিশ্বব্যাপী প্রায় সব দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য শিশুদেরও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ১৫ বছর আগে ইউনিসেফের সহায়তায় শিশুদের শিশু সাংবাদিকতায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সে ধারাটি বেগবান হয়নি।

    কোনো কোনো সংবাদপত্র তাদের পাঠক সংগঠনের মাধ্যমে শিশুদের সাংবাদিকতায় অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করেছে।
    স্বাভাবিকভাবেই বলতে হয়, বাণিজ্যিক মিডিয়ার লক্ষ্য সব পাঠক ও দর্শক। মুক্তমাধ্যম বলে শিশুরাও এসব রিপোর্টের পাঠক-দর্শক হতে পারে সহজে। সে কারণেই এ বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর এ কারণেই একটি নীতিমালা থাকা আবশ্যক। একই সঙ্গে এর প্রয়োগ নিয়েও সবার সচেতনতা কাম্য। আমাদের দেশে সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার জন্য সাধারণভাবে নীতিমালা অনেক আগে তৈরি করেছে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। তবে প্রেস কাউন্সিল সেই নীতিমালা কার্যকর করা হয় কি না সে ব্যাপারে নিজস্ব উদ্যোগে ভূমিকা রাখে না। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করলেই কেবল বিচার করে প্রেস কাউন্সিল। তখন নীতিমালার প্রসঙ্গটিও আসে।

    নীতিমালা প্রয়োগের বিশেষ উদ্যোগের জন্য কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সাংবাদিকদের নিবন্ধন করার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কাজ আসলে তথ্য অধিদপ্তর করে আসছে কয়েক যুগ ধরে।শিশু সাংবাদিকতা বাংলাদেশে চালু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এর ধরনটা বদলেছে কেবল। একসময় এটা সীমাবদ্ধ ছিল সপ্তাহান্তের শিশু পাতার মধ্যে। গল্প, কবিতা, জানা-অজানা তথ্য, ছবি আঁকা ইত্যাদি ছিল এর বিষয়। এখানেও শিশুদের অংশগ্রহণ ছিল লেখালেখির মাধ্যমে। শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট ও ফিচার প্রকাশিত হয়েছে, তবে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া তখন অবয়বগত কারণে সম্ভবও ছিল না। ১৯৬০ দশকের শেষ দিক থেকে এ বিষয়ে নতুন নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটে। 

    সাহিত্যের সমৃদ্ধ অঙ্গনের পাশাপাশি জীবনযাপনের এ সময় মৌলিক দিকের প্রতিও নজর দেওয়া শুরু হয়। তবে বলতেই হবে ১৯৯০ সালে শিশু অধিকার সনদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী আবারও পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং এবার শিশু অধিকারের প্রেক্ষাপটেই শিশু সাংবাদিকতাকে দেখতে শুরু করেন অনেকে। এ সময় বাংলাদেশে প্রথম ‘শিশু অধিকার ফোরাম’ প্রতিষ্ঠিত হলে শিশুবিষয়ক সব কর্মকাণ্ডে শিশুদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করে সংগঠনটি। শিশু সাংবাদিকতায় তাদের অংশগ্রহণের দিকগুলো তখন চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন একদল সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী।

    শিশু সাংবাদিকতার নীতিমালা আসলে শিশু অধিকার সংরক্ষণেরই অংশ বলে মানতে হবে। শিশুদের জন্য বড়রাই এ অধিকারগুলো চিহ্নিত করেছেন। কারণ শিশুদের পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। সেসব পালনে অগ্রণী ভূমিকা বড়দেরই নিতে হয়েছে। সে জন্যই শিশু সাংবাদিকতায় নীতিমালার প্রসঙ্গ এসেছে। তবে এটি শুধু কিছু ব্যক্তির বৈষয়িক সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যদি এর প্রয়োগের দিকটি গুরুত্ব দেওয়া না হয়। পরবর্তী কার্যক্রম হওয়া দরকার কে, কোথায় তা পালন করছে, কোথায় এর বরখেলাপ হচ্ছে সেটি মনিটর করা।

    সম্পাদকরা বা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা নীতিমালার পক্ষে যে মতামত দিচ্ছেন, তা কার্যকরে স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁরা কী ভূমিকা নিচ্ছেন সেটিও সবার জানা প্রয়োজন। এ ধরনের ব্যবস্থাই এ নীতিমালা প্রয়োগে সাফল্য আনতে পারে। মিডিয়া হাউসগুলো নিজস্ব নীতিমালা তৈরি করে তা তাদের ওয়েবসাইটে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা সময়ের দাবি। নীতিমালার বরখেলাপ হলে প্রেস কাউন্সিলের নিজস্ব উদ্যোগে সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাই হোক কাউন্সিলের একটি প্রধান দায়িত্ব। না হলে এটিও কাগুজে বা ভার্চুয়াল ডকুমেন্ট হয়েই থাকবে, শিশুদের কোনো উপকারে আসবে না। শিশু সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রকাশ করার পাশাপাশি এর প্রয়োগ ও শিশু সাংবাদিকতায় শিশুদের অংশগ্রহণ নিয়েও তৎপরতা দেখাতে হবে বড়দেরই।

    লেখক ও সাংবাদিক
    শিহাব আহম্মেদ
    সম্পাদক-আলোকিত ৭১ সংবাদ

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ