• ঐতিহ্য

    বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধ, সংগ্রাম ও নির্যাতনের ইতিহাস

      প্রতিনিধি ২১ আগস্ট ২০২২ , ৪:৩০:০৪ প্রিন্ট সংস্করণ

    ১৫ই আগস্ট কালরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা জাতির ললাটে এক কলঙ্ক লেপে দিয়েছিলো। সময় থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো যেন অনন্তকাল ধরে। জান্তার লৌহ বেষ্টনী টুঁটি টিপে ধরেছিলো সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির, একাত্তরের ন্যায় স্বদেশে নির্বাসিত স্বজাতি এক বৃহৎ কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছিলো। এমনি বৈরী সময়ে দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিলো বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ জনপদে। ফুঁসে ওঠে বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম। বিপ্লবের প্রজ্বলিত হোমানলে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য এগিয়ে আসে টগবগ করে ফুটতে থাকা একঝাঁক দ্রোহী তরুণ।

    চট্টগ্রামের এই বিদ্রোহ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। টাঙ্গাইলে বাঘা সিদ্দিকী যেমন সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিখ্যাত হয়ে আছেন, তেমনি চট্টগ্রামে মৌলভী সৈয়দও বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে দেশজুড়ে শুধু চাঞ্চল্যই সৃষ্টি করেন নি, জীবন দিয়ে তিনি অমরত্বের মহিমা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করার জন্য তাঁর সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন এস এম ইউসুফ ও এ. বি. এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। একাত্তরের এই তিন কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক আরেক মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন পঁচাত্তরে। তাঁরা আবার ভারতে গিয়ে সেদেশের সরকারের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প খুলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন।

    চট্টগ্রাম বারবার ইতিহাস হয়ে যায়। কখনো একুশের অসহযোগ, কখনো ত্রিশের বিপ্লবে, কখনো মাদার্শার খালকাটা আন্দোলনে, কখনো একুশের প্রথম কবিতা রচনায়, আবার কখনো বা হরিখোলা মাঠে পূর্ব পাকিস্থানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনে, কখনো ছেষট্টিতে লালদিঘি মাঠে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণায়, কখনো বা ইপিআর অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের স্বাধীনতা যুদ্ধ সূচনায়, কখনো বা ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে আবারো ইতিহাসে হয়ে যায় চট্টগ্রাম।

    পাকিস্থানের শাসকরা যাঁকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে পারেনি, তাঁকে কী না অঙ্গুলিমেয় বাঙালি ষড়যন্ত্রীরা গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো তাঁর উন্নত প্রশস্ত বুক। বাঙালি জনতা নয়, যাঁদের জন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন, তাঁরা তাঁকে হত্যা করতে পারে না, করেওনি তাঁরা। কারা মারলো তাঁকে? কতিপয় বিপথগামী সৈনিক বাঙালি নামধারী কুলাঙ্গার। গভীর রাতে জাতি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন ওই কাপুরুষরা তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে থামিয়ে দেয় একটি ইতিহাস, নিশ্চিহ্ন করে দেয় একটি জাতির পথচলা।

    জাতির সেই চরম সংকট-সন্ধিক্ষণেও বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম জেগে ওঠে দুর্দমনীয় প্রতিরোধের সংকল্পে। অমানিশার অন্ধকারে যখন ঢেকে গিয়েছিলো দিগবলয়, ভোরের প্রত্যাশায় রাত্রির তপস্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিলো, তখন চট্টগ্রামের বীরসন্তান মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ যেন ভোরের পাখি হয়ে প্রত্যুষের প্রহর ঘোষণা করেছিলেন। আগুনের তিনটি প্রজ্জ্বলিত শিখা হয়ে তাঁরা সূর্য অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের এই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের কথা খুব একটা আলোচিত হয়নি।

    দেশবাসি টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধের কথা জানে, কিন্তু চট্টগ্রামের সৈয়দ-মহিউদ্দীন-ইউসুফের বিদ্রোহের কথা জানে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের বিদ্রোহের বহু বছর পর সেদিনের রক্ত-আগুন-বিদ্রোহের অমর কাব্য উদ্ধার করা হলো। বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের বীর সন্তান সৈয়দ-মহিউদ্দীন-ইউসুফ সেদিন যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, ইতিহাসের স্বার্থে তা উদ্ধার করা প্রয়োজন। মৌলভী সৈয়দ নেই, এ বি এম মহিউদ্দীন, এস এম ইউসুফ- কেউই আজ বেঁচে নেই।

    পঁচাত্তরের সূর্য-তরুণরা না দাঁড়ালে বহু বছরের তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে রাত্রির অন্ধকার দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতো, ঘন তমসার বুকে ভোরের তপস্যা মাথা কুটে মরতো। বস্তুত পঁচাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধারা খাদের কিনারায় ঝুলে পড়া জাতিকে চূড়ান্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগকেও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের গ্রেনেড বোমায় দেশ প্রকম্পিত না হলে বিশ্ববাসী এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে কৌতুহলী দৃষ্টি সরিয়ে নিতো যে, প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে মুজিবের স্বাধীনতার স্বপ্নসৌধ ভেঙে পড়েছে।

    পঁচাত্তরে আরেকবার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে, শত্রু হননের কঠিন সংকল্পে বাংলার অস্ত্রবাজ তরুণরা জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে জাতিকে শোনালেন তিমির হননের গান, বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন মুজিব মরে নাই, সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো- “শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি লক্ষ মুজিবের কণ্ঠে উঠিছে আকাশে বাতাসে রণি”।

    কীভাবে শুরু হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ:
    ১৫ই আগস্টের শোকাবহ ঘটনার দু’দিন পর ১৭ই আগস্ট আগ্রাবাদ সরকারি কমার্স কলেজ মাঠে এক বৈঠক ডাকলেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। বৈঠকের শুরুতে তিনি বললেন, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বন্ধুবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ উনার পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করেছে ঘাতকরা। এ ব্যাপারে আমি মহিউদ্দীন চৌধুরী আপনাদের ডেকেছি, এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী সে বিষয়ে আলোচনা করতে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় ৫ হাজার প্রতিবাদী লোক ভারতে গিয়ে মহিউদ্দীন চৌধুরীর গ্রুপে যোগ দেন।

    মৌলভী সৈয়দ:
    নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর বাঁশখালীর প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ আচার্য্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে বিভিন্ন স্থানে সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এক পর্যায়ে মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেন। তিনি তখন বাকশাল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি। তিনি নতুন করে যুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে বলেন।

    মৌলভী সৈয়দ যে গোপনে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এবং সে লক্ষে সংগঠন গড়ে তুলেছেন, এ খবর সেনাবাহিনীর কানে পৌঁছে যায়। তারা মৌলভী সৈয়দের বাসায় হানা দিলে তিনি ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে দেশে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে যোদ্ধা রিক্রুট করে তাদেরকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র যোদ্ধাদের দেশের ভেতর পাঠিয়ে গেরিলা তৎপরতা চালান।

    মৌলভী সৈয়দ আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়ায় সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে একটি বাড়িতে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি ওই বাসা ছেড়ে আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডস্থিত ভান্ডার মার্কেটের পেছনে তাঁর খালার বাসায় ওঠেন। ওই বাসাটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই বাসায় অবস্থান করে মৌলভী সৈয়দ দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন।

    এম এ মান্নান, আতাউর রহমান কায়সার, মহিউদ্দীন চৌধুরী- এসব নেতৃবৃন্দ ছাড়াও শহরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকান্ডের পর মৌলভী সৈয়দ ঢাকায় গিয়ে গোপনে যুদ্ধের জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ৭ই নভেম্বর ঢাকায় মতিয়া চৌধুরী, খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইসহ যে বিশাল মিছিল বের হয়, তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন মৌলভী সৈয়দ। এরপর তাঁর পক্ষে দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

    তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এস এম ইউসুফ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, শফিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন, মো ইউনুছসহ আরো অনেকে তখন ভারতে আশ্রয় নেন। এরা ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার জননেতা ভারতে আশ্রয় নেন। সে সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকার ভারতের ক্ষমতায় ছিল। ৭১-এ যেহেতু ভারত সহযোগিতা করেছিল, স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি ভারত সরকারের দুর্বলতা ছিল। সেজন্য যেসব নেতা-কর্মী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি সহযোগিতা করেছিল। এর মধ্যে ভারত থেকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ, এ বি এ মহিউদ্দীন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ, কাদের সিদ্দিকী প্রমুখ।

    ১৯৭৬ সালে মৌলভী সৈয়দ ভারতে থাকাকালীন সময়ে তাঁর খালাতো ভাই সৈয়দ মাহমুদুল হক এবং সৈয়দ মো. গোলাম জাকারিয়া ভারতে চলে যান। এর মধ্যে মৌলভী সৈয়দ বিভিন্ন সময় ভারত থেকে আসা-যাওয়া করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের সংগঠিত করতে থাকেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে (বর্ডার এলাকায়) সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়া সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। সৈয়দ মাহমুদুল হক ভারতে কয়েকদিন অবস্থান করে দেশে চলে আসলেও সৈয়দ মো. জাকারিয়া মৌলভী সৈয়দের সাথে সেখানে থেকে যান।

    তারা চট্টগ্রামের নেতাদের সংগঠিত করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন তথ্য ভারতে মৌলভী সৈয়দের কাছে পাঠাতেন। মৌলভী সৈয়দ ভারত থেকে আসলে তাদের বাসায় অবস্থান করতেন। নভেম্বরের ৪/৫ তারিখ মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রামে অবস্থান নিয়ে নেতাদের উজ্জীবিত করেছিলেন। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে মৌলভী সৈয়দ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ এমপিদের নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ‘বাংলার ডাক’ নামে একটি পত্রিকা বের করা হতো। এটা ভারত থেকে প্রকাশ করা হতো। এগুলো নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিলি করা হতো।

    ৪-৫ই নভেম্বর স্টেডিয়াম, খালেক বিল্ডিংসহ (পুলিশ লাইন) ৪-৫টি জায়গায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর মৌলভী সৈয়দ সাথে সাথে তাদের বাসা থেকে সরে যান। ৭ নভেম্বর কর্ণফুলী মার্কেটের শাপলা টেইলার্স থেকে তার বড় ভাই সৈয়দ আবদুল গণিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে মাহমুদুল হকের বাবাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে আরেকটা দল ঈদগাহ থেকে মৌলভী সৈয়দের দোকান (এসবি সাইকেল স্টোর) থেকে সৈয়দ মো. জাকারিয়াকেও গ্রেপ্তার করে।

    এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী:

    বঙ্গবন্ধু যখন চট্টগ্রামে আসতেন, ট্রেন থেকে নেমেই প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমার মহিউদ্দীন কই?’ উনি সেই মহিউদ্দীন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি ক্যাম্পে শত নির্যাতনের মুখেও নতি স্বীকার করেননি। নির্যাতনের সময় পিপাসায় পাকিস্থানি মেজরের কাছে যখন পানি চেয়েছিলেন, তখন সেই মেজর বোতলে করে নিজের প্রস্রাব দিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি কেউ কল্পনা করতে পারে? তবুও মহিউদ্দীন মুখ খোলেননি।

    ১৫ই আগস্টের সেই বিপর্যস্ত সময়ে যখন সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হতবিহ্বল এবং প্রাণের ভয়ে আত্মগোপনে, সেসময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন যারা, তাদের অগ্রগণ্য মহিউদ্দীন চৌধুরী। সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি এবং তার সঙ্গীরা।

    মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামে তরুণ-যুবকদের আরও একটি রাজনৈতিক ধারা সক্রিয় ছিল। তারা ছিলেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারী। এই ধারার নেতারা মিলে একাত্তরে জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তারা চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম পাকিস্থানের পতাকা নামিয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। সেই জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডারদের একজন ছিলেন শ্রমিক নেতা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করলেন, তখন মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফ্রন্টের সদস্য করা হয়।

    ১৫ই আগস্ট রাতে মহিউদ্দীন ঢাকায় কমলাপুরের একটি হোটেলে ছিলেন। ওই রাতের প্রায় ১০টা পর্যন্ত মহিউদ্দীন ছিলেন রাজনৈতিক গুরু শেখ মনির বাসায়, যাকেও রেহাই দেয়নি ঘাতকেরা। মহিউদ্দীন চৌধুরী সেদিন ভাতও খেয়েছিলেন শেখ মনির সঙ্গে। পরদিন সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল মহিউদ্দীনের। সে অনুযায়ী সকালে কমলাপুর হোটেল থেকে বের হয়ে রিকশায় করে তিনি যাচ্ছিলেন মিন্টো রোডে মন্ত্রীর বাসায়।

    এক সাক্ষাৎকারে মহিউদ্দীন বলছিলেন, ‘রিকশায় বসে দেখি চারদিক থমথমে। সকাল ৭টার দিকে হঠাৎ একটি দোকানের ভেতরে রেডিওতে শুনি ডালিমের কণ্ঠ। শুনলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। দিশেহারা হয়ে আমি রিকশা থেকে নেমে যাই। মানুষের কাছ থেকে শুনলাম, মনি ভাইকেও নাকি খুন করা হয়েছে। তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিলাম, চট্টগ্রাম চলে যাব। ‘ঢাকা থেকেই আমি চট্টগ্রামের জিওসি গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন, বললেন আপনারা সবাই সংগঠিত হোন, প্রতিবাদ করুন। কিন্তু চট্টগ্রামে যারা সিনিয়র লিডার ছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গেই তখন যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি চট্টগ্রামে ফিরে আসি।’

    মহিউদ্দীন জানান, তিনি চট্টগ্রামে ফিরলেন, বিভিন্নভাবে ফিরলেন ঢাকায় থাকা তার চট্টগ্রামের সহকর্মীরাও। প্রথম দিকে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সিনিয়র নেতারা কেউ সায় দিলেন না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ফনীভূষণ মজুমদার, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পটিয়ার সংসদ সদস্য নূরুল ইসলামসহ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন শেখ মনির সৈনিকেরা। কিন্তু তারা তখন খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নিয়েছেন। তারা প্রতিবাদ করতে অপারগতা জানালেন। বাধ্য হয়ে শেখ মনির সৈনিকদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিলেন।

    মহিউদ্দীন বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রীরা সবাই তার অনুগত- এটা বোঝাতে পল্টনে জনসভা ডাকলেন খন্দকার মোশতাক। গোয়েন্দা সংস্থা-পুলিশ-সেনাবাহিনীতে ভরপুর পল্টন ময়দান। আমরা যারা মনি ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতি করতাম তারা বসলাম, কীভাবে জনসভা ভন্ডুল করা যায়। বোমা-গ্রেনেডে কাজ হবে না, সিদ্ধান্ত নিলাম জনসভায় সাপ ছেড়ে দেবো। সিদ্ধান্তটা আমারই ছিল, সবাই লুফে নিল। সাপ জোগাড়ও করলাম। মনি ভাইয়ের বডিগার্ড শাহাবুদ্দিন সাবু’র নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে সাপ ছেড়ে দিয়ে আসল। মিটিং ছেড়ে সবাই পালাল।

    ৭৫-এর অক্টোবরে গ্রেপ্তার হয়ে যান মহিউদ্দীন। সামরিক আইনে গ্রেপ্তারের প্রায় ৬ মাস পর রাজশাহী ‍কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ততদিনে তার রাজনৈতিক সহচরদের অনেকেই চলে গেছেন ভারতে। মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দীনও যান সেখানে। পরে আগরতলায় ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। হিমালয়ের তান্দুয়ায় হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ। আওয়ামী লীগের এমপি চিত্তরঞ্জন সুথার তাদের ভারতে নিয়ে যান। তিনি কয়েকজন এমপি’র মধ্যে একজন, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা করেছিলেন। ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার ভাই শেখ মারুফ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ,

    সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ই মার্চ কলকাতার লেকটাউনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবসের আয়োজন করা হয়, যেখানে এসেছিলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও। জন্মদিনে মিলাদের আয়োজন করা হয়। সেখানে চট্টগ্রামের সশস্ত্র যোদ্ধাদের দেখে শেখ হাসিনা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন তাঁকে ধরে আরেক রুমে নিয়ে যান মহিউদ্দীন বলেন, প্রশিক্ষণের সময় সেখানে যান প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম।

    তিনি মোশতাকের পক্ষ ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণরত তরুণ-যুবকরা আমরা সবাই মিলে তাকে ধরলাম সশস্ত্র প্রতিবাদে যুক্ত হওয়ার জন্য। তিনি বাংলাদেশ থেকে স্ত্রীকে নেওয়ার কথা বলে পালিয়ে যান। মিরসরাইয়ের ফজলুল হক বিএসসি তাদের সঙ্গে যোগ দেন। মোছলেম উদ্দিনও ছিলেন। ঠিক করি, প্রথমে থানা-ফাঁড়ি আক্রমণ করবো, রাস্তায় রাস্তায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাব। চট্টগ্রাম বন্দরকে নিজেদের আয়ত্তে নেবো। চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেব। এটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। ১৯৭৭ সালের প্রথমদিকে ‍তারা হাতে তৈরি কিছু গ্রেনেড পাঠান।

    এস এম কামালউদ্দিনের সেগুলো কৈবল্যধাম থেকে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু গোলদার নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী সেগুলো চট্টগ্রাম স্টেশনে আনতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কেউ চট্টগ্রামে ফিরে গ্রেনেড বানাতে শুরু করেন। বলুয়ারদিঘীর পাড়ের আবু তালেব আর আবু কালাম গ্রেনেডগুলো নিজেদের হেফাজতে রাখতেন। আগ্রাবাদ-আন্দরকিল্লায় কয়েক দফা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। এস এম কামাল উদ্দিন অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। বড় অপারেশন করতে না পারলেও প্রায় প্রতিদিন চট্টগ্রামে গ্রেনেড চার্জ করা হতো। এতে সরকার আমাদের সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা জেনে গিয়েছিল।

    তবে ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বাংলাদেশেও ক্যু, পাল্টা ক্যু’র ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। প্রশিক্ষণরত নেতা-কর্মীদের অনেককে পুশ ব্যাক করে ভারত। টিকতে না পেরে অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছেদ পড়ে। মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দীন চৌধুরী, অমল মিত্র, অমলেন্দু সরকারসহ ৩০-৪০ জন ভারতে থেকে যান। তখন আরও দুঃসহ অবস্থা।

    সেখানে থাকতে তাদের অনেককে পরিচয় গোপন করতে হয়েছে। কেউ মারা গেলে চুরি করে দাফন করতে হতো। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। নেতা হিসেবে সহকর্মীদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে মহিউদ্দীনের উপর। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন মহিউদ্দীন। সেটা জানাজানি হয়ে গেলে পেশা পরিবর্তন করেন তিনি। সাঙ্গু ভ্যালি নামে একটি রেস্টুরেন্টে বয় হিসেবে চাকুরি নেন।

    মহিউদ্দীন চৌধুরী বলেন, সাঙ্গু ভ্যালিতে বাম সংগঠন এসইউসি’র কর্মীরা বেশি জড়ো হতেন। তারা বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। অনেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। পাশাপাশি আরেকটি হোটেলে ভাত রান্নার চাকুরি নিই। কিন্তু মুসলমান বলে আমার রান্না করা ভাত খেতে আপত্তি ছিল অনেকের। ব্রাহ্মণ সেজে আরেকটি হোটেলে ভাত রান্নার কাজ নিই। এরপর পরিচয় গোপন করে আমি, অমল মিত্র, অমলেন্দু সরকারসহ কয়েকজন মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সাব-কন্ট্রাক্টরের অধীনে আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ নিই। মোটর ওয়ার্কশপেও কাজ করি কিছুদিন।

    অমল, অমলেন্দু, সুভাষ, সন্তোষ- এরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। তারাও আমার সঙ্গে অনেক কষ্ট করেছে। অমল আর অমলেন্দু দু’টাই ছিল বিচ্ছু। তাদের দুষ্টামির জ্বালায় মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারতো না, হাসতে হাসতে বলেন মহিউদ্দীন। ১৯৭৮ সালে মৌলভী সৈয়দ দেশে ফেরার সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। তাকে নির্মমভাবে গুলি করে খুন করা হয়। ফিরতে গিয়ে অমল মিত্র গ্রেপ্তার হন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৭৯ সালের দিকে গোপনে দেশে ফেরেন মহিউদ্দীন।

    জিয়া সরকার শুরু থেকেই তাদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেন। এর মধ্যেই একদিন ছদ্মবেশে মহিউদ্দীন যান টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে। মাজার বলতে কিছু ছিল না। বাঁশের সীমানাও ভালোভাবে ছিল না। যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, চট্টগ্রাম থেকে নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে যান তিনি। গোপালগঞ্জ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছিল। ফরিদপুর থেকে ইট আর সিমেন্ট সংগ্রহ করেন। বঙ্গবন্ধুর কবর ঘিরে পাকা দেয়াল তুলে দেন তিনি। দক্ষিণ কাট্টলী থেকে শ্বেতপাথরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ লিখে নিয়ে সেটা কবরে লাগিয়ে দেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

    এসব স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হন মহিউদ্দীন। কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে থাকেন। বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হবে, আমরা জানতাম। প্রতিবিপ্লব দমনের একটা প্রস্তুতি, আমরা যারা মনি ভাইয়ের গ্রুপ করতাম, আমাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এটাই, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন মহিউদ্দীন। [পুরনো সাক্ষাৎকার থেকে]

    এস এম ইউসুফ:
    এস এম ইউসুফ সারা বাংলাদেশে সবাইকে একত্রিত করেন। তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক জেলে থাকায় পুরো দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। ‘শামীম’ ছদ্মনাম নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে তিনি সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। আন্দোলন চালাতে গিয়ে নেতার অভাব থাকায় তিনি দেশের আনাচে কানাচে থেকে খুঁজে খুঁজে নেতা সৃষ্টি করেছেন। কাজী ইনামুল হক দানু, এস এম ফারুক, আনোয়ারুল আজিম, শামসুদ্দিন আহমদ, মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, মহিউদ্দীন রাশেদ, এম এ জাফর, কাজী আবু তৈয়ব, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আ ক ম শামসুজ্জামান- এঁরা এস এম ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত করেন।

    মিছিল, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ, পুস্তিকা প্রকাশ, পোস্টারিং:

    প্রতিরোধ যুদ্ধের দুটি দিক ছিলো। একদিকে প্রচার-প্রোপাগান্ডা। অন্যদিকে সশস্ত্র গেরিলা অপারেশন। মিছিল-সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ, চিকা মারা, পত্রিকা ও পুস্তিকা প্রকাশ এবং পোস্টারিং এর মাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো।

    ১৫ই আগস্ট সকাল ১০-১১টার দিকে নন্দনকানন থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন আনোয়ারুল আজিম, অ্যাডভোকেট জসিমউদ্দিন খান, এম এ জাফর, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান প্রমুখ। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ও ঘৃণা ব্যক্ত করেন। তারা চন্দনাইশ, সাতকানিয়া আসনের সাবেক এমপি ডা. বি এম ফয়েজুর রহমানের বাসভবনে মিলিত হন। তাদের পরিকল্পনা ছিলো মিছিল করে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনে যাবেন, কিন্তু ঢাকা থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়ায় সে পরিকল্পনা বাতিল হয়, মিছিলটি লালদিঘীর পাড়ের দিকে গেলে পুলিশ ধাওয়া করে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

    ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা খালেকুজ্জামান, জহীর কাজী, শফিক আদনান, আশরাফুল আলম বাবুল, ইসহাক মন্টু, এস এম জামালউদ্দীন বাবুল, আব্বাস দীপংকর চৌধুরী কাজল পরামর্শের জন্য জেল রোডের মোবারক বোর্ডিংয়ে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ মোহাম্মদ আইয়ুব বাঙালির কাছে ছুটে যান। অনেক আলাপ-আলোচনার পর শহীদ মিনারের সামনে মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক দিয়ে সামনের রাস্তায় মিছিল করা হয়।

    এরপর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদের ব্যানারে লালদিঘীর পাড়ে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশের পর নেতা কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। আজিজ কলোনিতে একটি মিছিল বের করা হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মিছিলকারীরা বাকলিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ফকির জামালের খামার বাড়িতে জমায়েত হন। পরবর্তীকালে রেয়াজুদ্দিন বাজার আমতলা, মাছ বাজারে বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিবাদে মিছিল বের করা হয়।

    আতাউর রহমান কায়সার, ডা. বি এম ফয়েজুর রহমান, এ কে এম আবদুল মান্নান, আনোয়ারুল আজিম, এস এম ফারুক, জসিমউদ্দিন খান, শামসুদ্দিন আহমদ চন্দনপুরা গুল-এ-জার বেগম স্কুলের পেছনে একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখান থেকে লিফলেট প্রকাশ করে বিভিন্ন থানা, ইউনিয়নে জনগণের মাঝে বিলি করে তাদেরকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হতো। এই রাজনৈতিক প্রতিরোধ কার্যক্রম স্কুল-কলেজ পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়।

    মার্শাল ল’ ভঙ্গ করে সমাবেশ ও ৭৫-এর ৪ঠা নভেম্বর সিটি কলেজ থেকে প্রকাশ্য রাজপথে মিছিল বের করা হয়। ৭ নভেম্বর পাঁচ/সাতশ লোক নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের করা হয়। মিছিল চলাকালে শহীদ মিনারে পুলিশ বাধা দেয়। ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান বাবুর সহযোগিতায় সর্বপ্রথম মধুর ক্যান্টিনে লিফলেট বিতরণ করা হয়। পটিয়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম শামসুজ্জামান এই লিফলেট বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।

    খ ম জাহাঙ্গীর, ফজলুল রহমান, রবিউল আলম মোক্তাদির, কামাল মজুমদার, মুকুল বোস, খুলনার শাহনেওয়াজ জামান আজাদ, বাহালুল মজনুন চুন্নু, ওবায়দুল কাদের (বর্তমানে যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী) প্রমুখ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতা মধুর ক্যান্টিন ভিত্তিক প্রচার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিতেন। কারফিউর মধ্যেও রাতে ঝটিকা মিছিল বের করা হতো। এ সমস্ত সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য নোয়াখালীর গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে ২১ জনের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড কমিটি গঠন করা হয়েছিলো, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন চট্টগ্রামের আ ক ম শামসুজ্জামান।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ কলেজ, বলাকা সিনেমা, গুলিস্তান সিনেমা, চট্টগ্রামের জলসা সিনেমা, আলমাস সিনেমা হলেও এই লিফলেট বিতরণ করা হয়। সেপ্টেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ একটি লিফলেট নিয়ে আসেন। লিফলেটের শিরোনাম ছিলো “বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ৬০ লক্ষ ডলারের কলঙ্ক”। তিনি এই লিফলেটটি নিয়ে হাটহাজারীর ফরহাদাবাদে অধ্যাপক আবু ছৈয়দের বাড়িতে যান। আবু ছৈয়দ, মো. ইসমাইল, সেকান্দর আলম চৌধুরী, হাবিবুর রহমান চৌধুরী নাজিরহাট রেল স্টেশন, নাজিরহাট বাজার, নুর আলী মিয়ারহাট ও কাটিরহাট বাজারে এই লিফলেট বিতরণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ‘বাংলার ডাক’ ও ‘জয় বাংলা’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়।

    প্রশিক্ষণ কেন্দ্র:
    প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম দিকে কিছু ছেলেকে শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্য আত্মগোপনে পাঠানো হয়। বোয়ালখালী, বাঁশখালী ও মহেশখালীর তিনটি স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বোয়ালখালীতে কেশব সেন, আবুল মনসুর সিদ্দিকী, রবীন্দ্রলাল রবি, অনিল দে, দীপেশ চৌধুরী, পীযুষ রক্ষিত ও নটু দত্ত, বাঁশখালীতে সুলতান উল কবির চৌধুরী ও সুভাষ আচার্য্য এবং মহেশখালীতে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম ও ইসহাক চেয়ারম্যান প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করতেন।

    মৌলভী সৈয়দ ভারতে অবস্থানকালে সেখানকার ‘তুরা’ নামক স্থানে প্রায় এক হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাকে দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যান। ভারতে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে মোরারজি দেশাই সরকার ক্ষমতাসীন হলে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সেনা শাসক জিয়ার সরকারের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ি যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তাদের সবাইকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে কথা ছিলো যে, জিয়া সরকার তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসিত করবে। কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে মৌলভী সৈয়দকে ময়মনসিংহ সীমান্তের অভ্যর্থনা শিবির থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে চরম নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশ সেনাবাহিনী বাঁশখালীর শেখেরখিল গ্রামে নিয়ে গিয়ে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কবর দেয়।

    অপারেশন:
    বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যারা ভারতে গিয়েছিলেন, তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উত্তর প্রদেশের সাহরানপুরে, ত্রিপুরার আগরতলা, রাধানগর, সাব্রুমসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মহিউদ্দীন চৌধুরী দিল্লিতে গিয়ে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করার পর কাদেরিয়া বাহিনীকে বৃহৎ পরিসরে সংগঠিত করা হয়। মহিউদ্দীন চৌধুরীকে এ বাহিনীর জোনাল কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট তাঁর কমান্ডের অধীনে ছিলো।

    চট্টগ্রামের অমল মিত্র, ফরিদপুরের সালাউদ্দিন, বরিশালের ফারুক, সন্তোষ, মাইদুল ইসলাম, অমিত, শাহজাহানসহ আরো বেশ কয়েকজন উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর এয়ার বেস স্টেশনে উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। মেজর জেনারেল স্টিফেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারের রতন দেব ও মেজর পি এস গিলেনসহ ৩২ জনের প্রশিক্ষক দল তাদেরকে টানা ছয় মাস প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ৪/৫ নভেম্বর নিউ মার্কেট, স্টেডিয়াম, খালেক বিল্ডিং-এ (পুলিশ লাইন) গ্রেনেড ফাটানো হয়।

    ১৯৭৭ সালের ৫ই জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যা ৭.৩৫ মিনিটে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বড় ধরনের একটি সফল অপারেশন চালানো হয়েছিলো। সেটা ছিলো সিরিজ বোমা হামলা। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন স্থানে একযোগে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রু শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন যারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় হতবিহ্বল ও মনোবল হারিয়ে হতাশার গ্লানিতে ভুগছিলো, তাদের মনোবল চাঙ্গা করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা যে বাঙালি জাতি মেনে নেয়নি বিশ্ববাসীকে একথা জানান দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরের ৮০টি স্থানে একযোগে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো।

    বাঁশখালীতে পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, কোতোয়ালি থানায় হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এছাড়া হাতে তৈরি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো আন্দরকিল্লা ও নিউমার্কেট মোড়ে।আউটার স্টেডিয়ামের মেলায়, হোটেল আগ্রাবাদের সম্মুখে, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের মাঝামাঝি স্থানে অপারেশন চালানো হয়। হোটেল আগ্রাবাদের সামনে গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে বাড়বকুন্ডের চেয়ারম্যান মহসিন জাহাঙ্গীর ধরা পড়ে যান।

    যাঁরা চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন:
    শহীদ মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ,কাজী ইনামুল হক দানু, সুলতান উল কবির চৌধুরী, জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু, গোলাম রব্বান, আনোয়ারুল আজিম, সুভাষ আচার্য্য, নায়েক শফিউল আলম, শফর আলী, আলতাফ হোসেন বাচ্চু, শফিকুল আহসান, ইসহাক মন্টু, মো, ইউনুছ, লিয়াকত আলী খান, সুনীল, জাফর আহমদ, আহমেদুর রহমান সিদ্দিকী, সন্তোষ ধর, জগলুল পাশা, অ্যাডভোকেট শ্যামল প্রসাদ সেন, আ ক ম শামসুজ্জামান, এম এ জাফর, কাজী আবু তৈয়ব, ফকির জামাল, কেশব সেন, পীযুষ রক্ষিত, দীপেশ চৌধুরী, শিশির দত্ত, সৈয়দ মাহমুদুল হক, শফিক আদনান, মোজাফফর আহমদ, সৈয়দ আবু সিদ্দিক, সৈয়দ মো, জাকারিয়া, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন, আবুল মনসুর সিদ্দিকী, নুরুল আলম চৌধুরী, এস এম ফারুক, আবুল হাসেম, অধ্যাপক মো. মঈনুদ্দীন,

    আবদুল মান্নান (বোয়ালখালী), অধ্যাপক শওকত হোসেন (ফটিকছড়ি), রেজাউল করিম, শামসুর রহমান, অধ্যাপক আবু ছৈয়দ, আবু সৈয়দ, খালেকুজ্জামান, দিদারুল আলম চৌধুরী (বাঁশবাড়িয়া), চেয়ারম্যান মহসিন জাহাঙ্গীর (বাড়বকুন্ড), সি-ইন-সি জাফর আহমদ, নোমান আল-মাহমুদ, ওয়াহিদুজ্জামান (চন্দনাইশ), অমল মিত্র, চন্দন লালা, শামসুদ্দিন আহমদ, মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান, জানে আলম, মহিউদ্দীন রাশেদ, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান, আবুল মনসুর (আনোয়ারা), ইউনুছ, আলী আহমদ (ডাক্তার), ইয়াছিন, শফিকুল ইসলাম (বাঁশখালী) আহমদ ইলিয়াছ (বাকলিয়া), শেখ মোহাম্মদ আইয়ুব বাঙালি, আমানত উল্লাহ খয়রাতি (চকবাজার), নাসিম, ইছা (চান্দগাঁও),

    মারুফ (মেডিকেল স্টাফ কলোনি), স্বপন (নবগ্রহ বাড়ি), বাবুল (ঢাকা), ইউসুফ, আলী আহমদ, আশরাফুল আলম বাবুল, দিদার, জাফর, কালু (দামপাড়া), খায়রুল ইসলাম (সীতাকুন্ড), সলিল বড়ুয়া, ওয়াহিদুজ্জামান, স্বদেশ, সন্তোষ (শাকপুরা), ইউসুফ (গহিরা), মৃদুল সরকার (জিরি), ব্রজবাবু (চক্রশালা), মোজাম্মেল হক, দিদারুল আলম, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ শফি, জয়নাল আবেদিন, মো. মোস্তফা, মো. হানিফ, কামাল (নান্টু), হারাধন মাস্টার, তপন, সন্তোষ, গোলজার (বাবু), ফয়েজ আহমদ, নুর আহমদ মাস্টার, ইলিয়াছ (দামপাড়া), বাবর, আনোয়ার, শফি, মনজু, ইসমাইল, সেকান্দর, নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান, নুরুন্নবী, রাখাল নাথ, ইউসুফ ওমর, শেখ মোহাম্মদ, জয়নাল আবেদিন ভোলা,

    তাজুল আহমদ, ইউসুফ বাহার, বিজয়, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, বদিউজ্জামান, বাবলু, রুবেল, মালেক, মোনাফ ডিলার, ডা. শওকত, নুরুল আলম, মোতালেব, হাসেম, গৌরি শংকর, শফিউল বশর, কবির চৌধুরী, মারুফ ডা. শফিউল আজম, ডা. ফরায়েজী, ডা. শামসু, জহীর কাজী, দীপংকর চৌধুরী কাজল, আশরাফুল আলম বাবুল, এস এম জামাল উদ্দিন বাবুল, বাবুল-আব্বাস (সাতকানিয়া), আবদুল মাবুদ মাস্টার, সরোয়ার জামাল লাতু, রূপন দাশ, সুনীল মামা, এস এম জামাল উদ্দিন (চকরিয়া), জিয়াউদ্দিন (চকরিয়া), ফৌজুল আজিম, অ্যাডভোকেট আইয়ুব খান, মহসিন, দীপেন আচার্য্য, নাসির, মোজাম্মেল, ইলিয়াছ (কাট্টলি), প্রবীর দত্ত বাবুল, ইসমাইল (ফটিকছড়ি), রফিকউদ্দিন সিদ্দিকী।

    যেসব আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে অবদান রেখেছেন:

    যে কোনো সংগ্রামে, যুদ্ধে ছাত্র, তরুণ, যুবকরাই নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারে। কারণ তাদের কোনো পিছুটান থাকে না। তাদের প্রায় সবাই অকৃতদার, স্ত্রী-সন্তান-সংসারের বন্ধন তাদের থাকে না। পিতামাতা ভাইবোনের স্নেহও সেই বয়সে তাদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারে না। সুতরাং ‘হ্যামিলনের বাঁশিঅলা’ মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দীন চৌধুরী, এস এম ইউসুফের ডাকে তাঁরা যে দলে দলে ঘর ছেড়েছিলেন রণদামামা বেজে উঠতে, সেটার তাৎপর্য এখানেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অধিকাংশেরই ঘর-সংসার, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা আছে। তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাদেরকে বহন করতে হয়।

    তদুপরি বিষয়-আশয়, বাড়িঘর, সম্পত্তির মোহ, বন্ধন- এসবের টান তুচ্ছ করে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে অনিশ্চিতের পথে, অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলার ঝুঁকি, সাহস প্রদর্শন করা মুখে বলা সহজ হলেও কাজে ততটাই কঠিন। তবুও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে, পরিবারের মায়া কাটিয়ে, সম্পত্তির লোভ পরিহার করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং হুলিয়া মাথায় নিয়ে তরুণ যোদ্ধাদের অস্ত্র, অর্থ, আশ্রয় জুগিয়েছিলেন। সশস্ত্র যোদ্ধাদের চেয়ে এই নেতাদের অবদান কোনো অবস্থাতেই ন্যূন নয়, হীন নয়?

    জাতির চরম দুর্যোগের দিনে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবনপাত করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন- আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আবদুল্লাহ আল হারুন, মোশাররফ হোসেন, এম এ মান্নান, এম এ ওহাব, সিরাজ মিয়া, আতাউর রহমান কায়সার, এ কে এম আবদুল মান্নান, ইদ্রিস বি কম, ডা. বি এম ফয়েজুর রহমান, এস এম জামাল উদ্দিন, কক্সবাজারের অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, মহেশখালীর ইসহাক বি এ, ফিরিঙ্গিবাজারের জাকেরুল হক চৌধুরী, বি. আলম চৌধুরী, আনছারুল হক, বাঁশবাড়িয়ার দিদার চেয়ারম্যান,দামপাড়ার জাফর কন্ট্রাক্টর, কালু।

    সেসময় তেমন কারো কাছে টেলিফোন ছিলো না। আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায় ছিলো। চট্টগ্রামের প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতারা তাঁর বাসায় গিয়ে ঢাকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন। আখতারুজ্জামান বাবুর বাসা সবার কাছে নিরাপদ থাকায় সেখানে সকল শ্রেণির নেতার সমন্বয় ঘটতো।

    চট্টগ্রাম ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা:
    বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠেছিলো, তাতে ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার চরম দমননীতি অবলম্বন করে। বাঁশখালীর প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান উল কবির চৌধুরী, পটিয়ার শামসুদ্দিন আহমদ ও মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীকে হাজি ক্যাম্পের সেনা শিবিরে নিয়ে ‘তক্তা ডলা’ দিয়ে উন্মাদবৎ অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত তিনটি দেহ চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। এরকম নির্যাতনে শাহাদাত বরণ করেন দোহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাসদ নেতা আবু তাহের খান খসরু। চট্টগ্রামের বিদ্রোহের জন্য তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে তিনটি মামলাকে একত্রিত করে একটি চার্জশিট দেয়া হয়। সরকার পক্ষ মামলাটির নামকরণ করে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’।

    শহীদ মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট শ্যামল প্রসাদ সেন, কেশব সেন, সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া, সৈয়দ আবু সিদ্দিক, পীযুষ রক্ষিত, দীপেশ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন, সৈয়দ মাহমুদুল হক, ফকির জামাল, শফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আবদুল গণি, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, মো. ইউনুছ, সুভাষ আচার্য্যসহ ১৬ জনকে মামলার আসামি করা হয়। মামলা পরিচালনার জন্য অ্যাডভোকেট খান শফিকুল মান্নানের নেতৃত্বে একটি আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়। অ্যাডভোকেট সুখেন্দু গুহ মামলার শুনানি করেছিলেন।

    সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর মামলা জেলা জজ আদালতে গেলে সেখানে প্রত্যেক আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে খালাস দেয়া হয়। চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের জন্য আখতারুজ্জামান বাবুর আর্থিক সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদের ব্যানারে লালদিঘি ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। এই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান মন্ত্রি ওবায়দুল কাদের। বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক খবর পত্রিকার সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান। জনসভা পরিচালনা করেছিলেন ছাত্রনেতা শফিকুল আহসান।

    তথ্যসূত্র: আলোকিত ৭১ সংবাদ

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ