• আইন ও আদালত

    প্রবেশন আইনের কথা ভুলে গেলেই ভুল হবে

      প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ , ৩:০৬:৫৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    নিউজ ডেস্ক:

    প্রবেশনের প্রথম বিকাশ ঘটে আমেরিকায়। জন অগাস্টাসকে প্রবেশনের জনক বলা হয়। তিনি বোস্টনের একজন জুতার কারিগর (মুচি) ছিলেন। ১৮৪১ সালে বোস্টন পুলিশ কোর্টের একজন বিচারককে তিনি আসামির পুনর্বাসনের বিষয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বপ্রথম তিনি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত মাতালকে তার হেফাজতে নিয়েছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দুই সহস্রাধিক মানুষকে সাহায্য করেছিলেন, যার মধ্যে মাত্র চারজন অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৮৭৮ সালে বোস্টনের মেয়র একজন সাবেক পুলিশ অফিসারকে প্রথম অফিশিয়াল প্রবেশন কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেন।

    সম্প্রতি আপিল বিভাগ ‘নুর মোহাম্মদ বনাম সরকার এবং অন্যান্য’ মামলার রায়ে মন্তব্য করেন, “আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ও আপিল আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন, আমাদের দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৮৬০’ নামে একটি আইন আছে।” বলতে দ্বিধা নেই, অনেকে বোধহয় এটিও ভুলে গেছেন, আসামিকে জেলে পাঠানোই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং তার সংশোধন হলো মুখ্য। জেলে পাঠানো হয় সে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এবং তার নিরাপত্তার জন্য। এজন্য কারাগারের ফটকে বড় করে লেখা থাকে ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’।

    দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জেলে না পাঠিয়ে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেওয়ার ব্যবস্থাপনাই প্রবেশন। প্রাথমিকভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬২ ধারা অনুযায়ী প্রবেশন আদেশ দেওয়া যেত। দণ্ডবিধিতে বর্ণিত প্রথমবারের মতো চুরিসহ অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড সংবলিত যে কোনো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামির জন্য এটি প্রযোজ্য ছিল। সেক্ষেত্রে আসামির ভালো আচরণ ছিল প্রবেশনের পূর্বশর্ত। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮০ ও ৫৬২-৫৬৪ ধারায় এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত ছিল। ১৯৩১ সালে ‘সর্বভারতীয় প্রবেশন বিলের’ খসড়া প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু খসড়া বিল পাশের বিলম্বের কারণে প্রদেশগুলোকে প্রবেশন আইন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রাদেশিক সরকারগুলো সে অনুযায়ী প্রবেশন আইন প্রণয়ন করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ভারতে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডারস অ্যাক্ট’ পাশ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে বর্তমান ‘প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ প্রণীত হয়। ১৯৭১ সালে একটি বিধিমালাও প্রণীত হয়।

    অধ্যাদেশটির ধারা ৫ অনুযায়ী, আদালত মহিলা আসামির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ ব্যতীত সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন আদেশ দিতে পারেন। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধসহ অন্যান্য কতিপয় অপরাধ ব্যতীত সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন আদেশ দিতে পারেন। এমনকি বিশেষ আইনের অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রবেশন আদেশ দেওয়া যায়। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ ‘মতি মাতবর বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে প্রবেশন প্রদান করেন। আইন অনুযায়ী, আদালত কোনো অপরাধীকে এক বছর থেকে অনধিক তিন বছর পর্যন্ত প্রবেশনে থাকার আদেশ দিতে পারেন।

    বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, কারান্তরিন আসামির সংখ্যা দেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে মোট কারাগার সংখ্যা ৬৮, যার ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজারের মতো। বর্তমানে বন্দির সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। কোনো কোনো সময় এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হয়ে থাকে। ফলে আসামিদের সংশোধন, নিরাপত্তা বিধান, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থাপনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আসামির সংখ্যাধিক্য, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং প্রকৃত অপরাধীদের সাহচর্যের কারণে তাদের ওপর নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ কারণে অনেকেই জেল থেকে ফিরে আসে অপরাধপ্রবণ মানসিকতা নিয়ে।

    প্রবেশনের বিশেষত্ব এখানেই। প্রবেশনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোনো পরিস্থিতির আশঙ্কা থাকে না। আসামি প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। শ্যেন দৃষ্টির কারণে সে কোনো অপরাধের সংস্পর্শে যেতে পারে না। পেশা বা কর্মের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে বিধায় তার মস্তিষ্কে নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেক হয় না। আসামির আয়-উপার্জনের সুযোগ থাকায় পরিবারের সদস্যরাও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। মৌলিকভাবে প্রবেশনের উদ্দেশ্যই হলো অপরাধ প্রতিরোধ, আসামির পুনর্বাসন, সংশোধন এবং তাকে সমাজের মূলধারায় ধরে রাখা বা ফিরিয়ে আনা। প্রবেশন আইন প্রয়োগে হাইকোর্ট প্রদত্ত ‘আব্দুল খালেক বনাম হাজেরা খাতুন’ মামলায় এমন অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।

    বাস্তবতা হলো, অনেক তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে উদ্ভূত মামলার কার্যক্রমও গড়ায় একেবারে আপিল বিভাগ পর্যন্ত; যা প্রথম ও নিু আদালতেই শেষ হয়ে যেতে পারত। অথচ এমনসব তুচ্ছ বিষয়ের জন্যও সর্বোচ্চ আদালতসহ সব আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। ফলে সৃষ্টি হয় মামলাজট ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। প্রবেশন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যারও অনেকখানি নিরসন হতে পারে।

    এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক প্রবেশন আইনের প্রয়োগ একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য। নিু আদালতের অবস্থাও তথৈবচ। আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে অসচেতন। তাদের মধ্যে সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি এ সম্পর্কে অজ্ঞতাও রয়েছে। অনেকে জানেনই না এমন একটি সুন্দর আইনি ব্যবস্থার কথা। অন্যদিকে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত কাঠামো হতাশাব্যঞ্জক। কিছুদিন আগের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে মাত্র ৪৪ জন প্রবেশন কর্মকর্তার পদ রয়েছে, যারা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত। কিছু জেলায় প্রবেশন কর্মকর্তাই নেই। যারা আছেন তারাও অনেকটা কর্মহীন। ফলে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব তো রয়েছেই।

    বছর দুই আগে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। এতে নিু আদালতের বি।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ