• খুলনা বিভাগ

    অসহায়দের কাছে ‘বেলাশেষে’ হয়ে উঠেছে শেষ আশ্রয়স্থল

      প্রতিনিধি ১ এপ্রিল ২০২৪ , ৪:১১:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ

    মো.মাহাফুজুর রহমান-নড়াইল জেলা প্রতিনিধি:

    দোতলা অট্টালিকার নিচের তলায় বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সুনাবান ও পূর্ণিমা মণ্ডল নামে দুই বৃদ্ধ। দুজনেরই বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারা। সম্ভাবত সেই দৃষ্টি সবকিছু ভেদ করে পৌঁছে গেছে তাদের অতীতে। একপলকে অতীত জীবনের হিসাব কষছেন তারা। হিসাব হয়তো মিলছে না। এক সময় যাদের জন্য প্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলেন, বর্ধাক্যের অসহায়ত্বে ছেড়ে গেছেন তারা। বেলাশেষে তাই দুই বৃদ্ধ নারীর ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।

    জীবনের গল্প জানতে এগিয়ে গেলে বৃদ্ধ সুনাবান বলেন, তার বাড়ি নড়াইল পৌরসভার ভাটিয়ায়। তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার কাছে যেতে পারেন না। সাতটা সন্তানের কেউ বেঁচে নেই। এখন কোথাও কেউ নেই তার। থাকার মধ্যে আছন তিনটি বোন। বৃদ্ধাশ্রমে আসার আগে তাদের কাছেই থাকতেন তিনি। বোনদের মধ্যে একজনই তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। এখানে ভালই আছেন। থাকা-খাওয়ায় কোন সমস্যা নেই। ইফতারি-সেহরিতেও ভালো মানের খাবার পাচ্ছেন। বোনের বাড়ি মাঝে মাঝে বেড়াতেও যান তিনি। তবে সম্প্রতি বোন হজ্বে গেছেন। তাই সে বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয় না।

    পার্শ্ববর্তী জেলা যশোর থেকে বৃদ্ধাশ্রমে আসা পূর্ণিমা মণ্ডল বলেন, চার ভাই এক বোনকে মানুষ করেছেন। এখন ভাই-বোন তাকে চেনে না। তাদের মানুষ করেছেন, কিন্তু কপাল পুড়েছে তার। ভাই-বোন মানুষ করতে গিয়ে জীবনে বিয়ে করতে পারেন নি। এখন তারা কেউ কোন খোঁজ খবর নেয় না। তাই নিজেই এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দুই বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন। এখানে থাকা-খাওয়ার কোন সমস্যা নেই।

    শুধু সুনাবান বা পূর্ণিমা মণ্ডল নয় তাদের মত আরও ৫ জন অসহায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষের ঠাঁই হয়েছে নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নের আলোকদিয়ায় গড়ে ওঠা ‘বেলাশেষে’ বৃদ্ধাশ্রমে। ২০২২ সালে পারবারিক উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি চালু করেন নড়াইল জজ কোর্টের আইনজীবী হেমায়েত উল্লাহ হিরু। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে এসেছেন মোট ৩২ জন অসহায় বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। এরমধ্যে অনেককেই তাদের পরিবারের মানুষেরা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে রয়েছেন ৪ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। বর্তমানে প্রায় ৪০ জনের আবাসনের সুব্যাবস্থা রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমটিতে। কোন কিছুরই অভাব নেই। ফলে অসহায়দের কাছে বেলাশেষে হয়ে উঠেছে শেষ আশ্রয়স্থল।

    কিশোরগঞ্জ থেকে বৃদ্ধাশ্রমে আসা দুলালুর রহমান খাঁন (৭৬) বলেন, জায়গা-জমি যা ছিলো মেয়েকে লিখে দিয়েছিলেন। মেয়ে তাকে কাছে রাখতে চায় কিন্তু জামাই রাখে না। তাই মেয়ে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন। মেয়ে ফোনে খোঁজখবর নেয়। কিন্তু বাড়িতে ফিরিয়ে নেয় না। একবারে ফিরে যেতে মন চাই তার কিন্তু মেয়ে ভরণপোষণ দিতে পারবে না ভেবে এখানেই আছেন৷ এখানে আল্লাহ তাকে ভালই রেখেছে।

    তিন মাস আগে এই বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন মুন্সী আব্দুল্লাহ (৬৩) নামে আরেক বৃদ্ধ। তিনি এসেছেন নড়াইল সদর উপজেলার কামালপ্রতাপ গ্রাম থেকে। তিনি বলেন, আগে ট্রাকের ড্রাইভার ছিলেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারও ছিলো তার। পরে স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়। নয় বছরের মেয়েটিও এখন তার মায়ের কাছে থাকেন। তাকে দেখার মত কেউ নেই৷ শরীরও অসুস্থ। এখানে ভালই আছেন। থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে৷

    বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাডভোকেট হেমায়েত উল্লাহ হিরু বলেন, অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই পারিবারিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তুলেছেন। এখানে আসা অসহায়ের বিনা পয়সায় থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নেয়া হয়েছে নানান পরিকল্পনা। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে৷ সাধারণ মানুষকে উদ্যোগি করতে নির্দিষ্ট একটা ফি জমাদানের মাধ্যমে তাদেরকে দাতা সদস্য করা হচ্ছে।

    তিনি আরো বলেন, এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা দেখতেছি খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে বয়স্ক লোকের চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। ফলে যাকাত তহবিলের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই টাকা শুধু চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হবে। তাই বিত্তবানদের যাকাতের টাকা এখানে দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
    এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বলেন, শেষ বয়সে এসে মানুষ খুব অসহায় জীবন যাপন করে। এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং সওয়াবের কাজ। আমি বিত্তবানদের আহ্বান করব এই অসহায়দের আশ্রয়স্থল বেলাশেষের পাশে এসে দাঁড়াতে।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ