• চট্টগ্রাম বিভাগ

    সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব বিলীনের পথে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘী।

      প্রতিনিধি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ , ১১:৪৯:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

    এটা কোন রুপকথা বা সিনেমার গল্প নয়, ইতিহাসের এক বাস্তব প্রতিফলন, অযত্নে অবহেলায় পরে আছে, সংস্কারের অভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিলীনের পথে আর এই বাস্তব জানতে ও দেখতে হলে যেতে হবে, পটুয়াখালী জেলা বাউফল উপজেলার ১নং কাছিপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘী।আনুমানিক শতাধিক বছর পূর্বে এই এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য এই দিঘীটি খনন করা হয়েছিল।সেই থেকে দিঘীটি এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের যোগান দিয়ে আসছিল।তখনও দিঘীটির কোন নির্দিষ্ট নাম ছিলনা।কথিত আছে, শতাধিক বছর পূর্বে কাছিপাড়া গ্রামের দিঘীর পাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কানাই-বলাই নামে দুই ভাই থাকতো। দুই ভাই প্রতিদিন ভোর রাতে উঠে নিজ গ্রামের সকল হিন্দু বাড়িতে বাড়িতে নাম কীর্তন করতো।একদিন সকালবেলা দুই ভাই স্নান করছিল, খেজুর গাছের ঘাট ভেবে দুটি বিশালাকার গজাল মাছের উপর বসে। শরীরে সাবান দেয়ার সময় মাছ দুটি দুই ভাইকে নিয়ে জলের গভীরে চলে যায়। এরপর আর কোনোদিন দুই ভাইয়ের দেখা মেলেনি। তারপর থেকেই এ দিঘীটি কানাই-বলাই দিঘী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনেকরেন কানাই-বলাই দিঘী তাদের কাছে একটি তীর্থস্থান। সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব বিলীনের পথে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘী।
    একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী দর্শনার্থী কাজল রাণী দাস বলেন, আমরা হিন্দুরা মনেকরি এই কানাই-বলাই দিঘী আমাদের কাছে একটি তীর্থস্থান।আমি প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এখানে আসি পূজা-অর্চনা করতে এবং দিঘীর জলে দুধ, কলা দিতে ও স্নান করতে। অনেকবার আমি মানত করছি,আমি ফল পাইছি।আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করব যাতে কানাই-বলাই দিঘীকে সংস্কার করে আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদে তীর্থস্থানকে রক্ষনাবেক্ষন করে।

    একজন মুসলিম নারী দর্শনার্থী খাদিজা বেগম বলেন, একবছর আগে আমার ছেলে হারানো গিয়েছে,আমি আমার ছেলেকে পাবার জন্য মানত করেছিলাম,যদি আমার হারানো ছেলেকে ফিরে পাই তাহলে কানাই-বলাই দিঘীতে আমার ছেলেকে গোসল করাব, আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি,তারপর থেকে আমি সবসময় এই দিঘীতে আসি আমার ছেলে,মেয়ে,স্বামীকে নিয়ে। আমি মনেকরি কানাই-বলাই দিঘী একটি পবিত্র স্থান, এখানে মানত করলে মনবাসনা পূরণ হয়। এই বিশ্বাস নিয়েই আমি এখানে আসি।্। নীয় নারী বাসিন্দা মরিয়ম আক্তার বলেন, এখানে যারা ভালো মন নিয়ে আসে তাদের সকল ইচ্ছে পূরণ হয় দেখেছি, আর যারা কানাই-বলাই দিঘীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে না বা কটূক্তি করে তাদের বিপদ হয়। তিনি আরও বলেন, প্রায় বিশ বছর আগে তৎকালীন কাছিপাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে এসে কানাই-বলাই দিঘী তল্লাশি করার সময় এক ছাত্র জলের নিচে অনেক ঘর বাড়ি দেখতে পায় এবং সেটা জলের নিচ থেকে কারও কাছে বলতে বারণ করে। তারপরেও সেই ছেলেটা তা সবাইকে বলে দেয়। পরে দিঘীর পাড়েই ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পরে। তার কিছুদিন পরেই সেই ছেলেটা মারা যায়।
    স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মাছুদ গাজী বলেন, আমার বাপ,চাচাদের কাছ থেকে কানাই-বলাই দিঘীর সম্পর্কে আনেক ঘটনা শুনেছি। কানাই-বলাই দিঘী সত্য না মিথ্যা এটা পরীক্ষা করার জন্য আসে উপজেলার মাধবপুরা গ্রামের এক মহিলা তিনিও জলের নিচে কি আছে সেটা দেখার জন্য দিঘীর জলে ডুব দেয়, সেই মহিলা ডুব দেয়ার পর দিঘীর পানিতে তলিয়ে যায়, চার দিন পরে তার লাশ ভেসে উঠে। এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনা আছে এই কানাই-বলাই দিঘীকে ঘিরে। কার বাড়িতে আনুষ্ঠান পড়লে কানাই-বলাই দিঘীর পারে গিয়ে সংখ্যা বলে খাবার দাবারের হাড়ি,পাতিল,প্লেট, চাইলে দিঘী থেকে উঠে আসতো আবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে হাড়ি পাতিল,প্লেট, দিঘীর পারে রেখে আসলে অলৌকিক ভাবে দিঘীর পানিতে চলে যেত।
    স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, এই দিঘী থেকে ক্ষতি হয়েছে গুটি কয়েক লোকের কারণ তারা এটাকে অবিশ্বাস করতো বলে কিন্তু যুগ যুগ ধরে এর সুবিধা ভোগ করে আসছে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ ও এই এলাকার লোকজন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে কানাই-বলাই দীঘীতে।করোনা ভাইরাসের কারনে আগের চাইতে কানাই-বলাই দিঘীতে দর্শনার্থী সংখ্যা কম নইলে প্রতিদিন অনেক লোক আসত।

    স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আব্দুল মান্নান শরিফ বলেন, আমার বাড়ি এই কানাই-বলাই দিঘীর পারে,আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি দিঘীটি। আমি দিঘীর পারে ওরস করি প্রতিবছর ০৯,১০,১১ ই ফাল্গুন ওই দিঘীর পাড়ে ।আমার ওরস দেখতে দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসে এই দিঘীর পারে।এ সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বী দূর দূরান্ত থেকে এই দিঘীর জলে স্নান করতে আসেন।

    পটুয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, খলিলুর রহমান মোহন মিয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি কিছুদিন আগে কানাই-বলাই দিঘী পরিদর্শন করেছি,আমার জেলা পরিষদের পক্ষথেকে আর্থীক সহযোগিতা করেছি, দিঘীতে ঘাটলা ও মহিলারা যাতে গোসল করে জামা কাপড় পাল্টাতে পারে তার জন্য একটি ছোট পাকা ঘর করে দিয়েছি, কানাই-বলাই দিঘীর ইতিহাস ঐতিহ্য তথা পটুয়াখালী জেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানকে আমার জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সবধরনের সাহায্যে সহযোগীতায় আমি সর্বত্র পাশে থাকব বলে জানান তিনি।

    এছাড়াও স্থানীয় লোকজনের মনে এই দিঘী ঘিরে রয়েছে আরো নানান রহস্যজনক কথা। দিঘীর গভীরতা কেউ বলতে পারেন না আজও। কেউ মনে করেন এই দিঘীর কোন তলদেশ নেই। কেউ কেউ মনে করেন এই দিঘীর জলে রয়েছে সোনার হাড়ি পাতিলের রহস্যের ইতিহাস।

    কানাই-বলাই দিঘীতে মানুষরা আসে তাদের মনবাসনা পূরণ, মানত ও নিজেকে পবিত্র করার জন্য এবং তা ঠিকঠাক ভাবেই পূরণ হয়। হিন্দু,মুসলমান নির্বিশেষে আসে মনবাসনা পূরণের লক্ষ্যে, দিঘীর জলে দুধ, কলা দিতে ও স্নান করতে। বিশ্বাস, ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে হাজারও মানুষ শত বছর ধরে তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘীতে আসে মুক্তিলাভের আশায়।

    যুগযুগ ধরে চলে আসা বিশ্বাসের তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘীটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব বিলীনের পথে তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘী। দিঘী সংস

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ