• Uncategorized

    দেশের উচ্চপদস্থ লোকেরাও জড়িয়ে পড়ছেন ছিনতাইয়ের কাজে।

      প্রতিনিধি ৩ আগস্ট ২০২২ , ৯:০৯:৫৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    একজন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, একজন শিক্ষক। দুজনই চাকরি করতেন নিজ নিজ ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানে। করোনাকালে কারও বেতন কমে, কারও চাকরি চলে যায়। অভাব-অনটন কিংবা বেঁচে থাকার তাগিদে তারা যুক্ত হন অপরাধ জগতে। ক্রমে হয়ে ওঠেন পেশাদার ছিনতাইকারী। বাইক ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকা ছিনতাই হয়ে ওঠে তাদের কাছে সহজ শিকার। এই দুই পেশা ছাড়াও চিকিৎসক কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও ছিনতাইয়ের মতো সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার রেকর্ড নথিভুক্ত হয়েছে পুলিশের কাছে।

    পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ইদানীং ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং ও শিক্ষকতার মতো পেশার লোকজনও। পেশাজীবী থেকে এসব ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন পেশাদার ছিনতাইকারী। রাজধানীর ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন আশরাফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। করোনাকালে বেতন কমে যাওয়াসহ নানান কারণে জড়িয়ে পড়েন ছিনতাইয়ে। এখন তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার ছিনতাইকারী।

    মাসুদ রানা হাওলাদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারেও ইংরেজি পড়াতেন। কিন্তু করোনার মধ্যে স্কুল ও কোচিং সেন্টারের চাকরি হারান তিনি। হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে অভাব ও হতাশা। একপর্যায়ে একটি ছিনতাইচক্রে যোগ দেন। বাড্ডা, রামপুরা, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে বেড়ান তিনি।

    গত বছরের ডিসেম্বরে মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকায় এক সরকারি কর্মকর্তার ১১ লাখ টাকা ও পরে মোহাম্মদপুরে আরেক সরকারি কর্মকর্তার ২৩ লাখ টাকা ছোঁ মেরে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান দুই ছিনতাইকারী। এ দুই ঘটনার পর অভিযানে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এতেই বেরিয়ে আসে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের পরিচয়। শুধু ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষকই নন, এ তালিকায় রয়েছেন ডাক্তার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।

    পেশাজীবীদের ছিনতাইয়ে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যতিক্রম বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার আলোকিত ৭১ সংবাদকে বলেন, ‘সমাজের প্রথমসারির পেশার যেসব ব্যক্তি ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়েছেন তাদের দিয়ে ওইসব পেশায় জড়িত অন্যদের বিচার করা যাবে না। আমরা ব্যতিক্রমী কয়েকটি ঘটনা পেয়েছি। একেকজন একেক কারণে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

    বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশেষ পেশায় যুক্ত হলেই কোনো ব্যক্তি চারিত্রিক বা মানবিক হবেন এমনটি নয়। কারণ আমাদের দেশে মানবিকতা, সামাজিকতা ও সততার শিক্ষা তেমনটা নেই। আবার সব পেশায় সবাই ভালো আছেন তাও নয়। যারা আর্থিকভাবে ভালো নেই তারাই অপরাধ পুঁজি করে বেঁচে থাকতে চান। আবার মাদকাসক্ত ব্যক্তি যে পেশায়ই যান না কেন তিনি ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. তৌহিদুল হক আলোকিত ৭১ সংবাদকে বলেন, ‘একজন মানুষ গড়ে ওঠার সময় যদি অসদুপায় অবলম্বন করেন কিংবা আশপাশে নৈরাজ্য ও অনৈতিকতা দেখে বড় হন তাহলে তার মধ্যে অপরাধ কর্মকাণ্ড সংগঠনের প্রবণতা থাকবেই। ফলে কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক হলেই চারিত্রিকভাবে ভালো হবেন কিংবা মর্যাদাবান ব্যক্তি হবেন তা বলা যাবে না।’

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মেহ্জাবীন হক আলোকিত ৭১ সংবাদকে বলেন, ‘একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। তারা মূলত এমনভাবে বেড়ে ওঠেন যেখানে ন্যায়-অন্যায় বোধ কাজ করে না।’সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও সমাজে প্রচলিত ভালো পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছিনতাইয়ের মতো এমন অপরাধের জন্য পরিবার ও শিক্ষাপদ্ধতিকেই বেশি দায়ী করেন এ মনোবিজ্ঞানী।

    অধ্যাপক ড. মেহ্জাবীন হক আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের শিশুরা একটি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। অনেক সময় শিশুদের আমরা মানবিক শিক্ষা নয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা কিংবা অন্যায় করে ভালো করার মানসিকতা তৈরি করে দিচ্ছি। ছোটবেলা থেকে মা-বাবা ও পরিবারের অন্য কাউকে দেখে বড় হয়ে যখন কেউ উচ্চশিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন তাকে নৈতিকতা শেখানোটা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে অনেকে নাম করা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিক্ষক হওয়ার পরও অসদুপায় অবলম্বন করছেন।’

    এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সমাজের মানুষকে ভালো রাখার জন্য সমাজে গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোর চর্চা করা দরকার। এর মধ্যে বৈষম্যের জায়গাটা কমাতে হবে। মাদক বিস্তারের প্রবণতা কমাতে হবে। একজন অবৈধভাবে অর্থোপার্জন করে খুব বেশি এগিয়ে যাচ্ছেন আরেকজন কিছুই করতে পারছেন না। এ বিষয়গুলোতে যদি রাষ্ট্র নীরব ভূমিকা পালন করে তাহলে এমন পরিস্থিতি থেকে কখনোই মুক্তি মিলবে না বরং বাড়বে। জনগণকে স্বাভাবিক ও নিশ্চিত জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে সে ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার তুলনায় নৈতিকতায় জোর দিতে হবে।’

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ