• জাতীয়

    খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: এ এন এম নূরুজ্জামান,বীর উত্তম

      প্রতিনিধি ২৯ আগস্ট ২০২৩ , ২:৫২:১০ প্রিন্ট সংস্করণ

    মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা তথা জাতির বীর সন্তানেরা কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর নয় তারা পুরো বাঙ্গালী জাতির অহংকার । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন জনকে তাদের অবদানের ভিত্তিতে বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। বীর উত্তম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরষ্কার। মোট ৬৭ জনকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ ৬৭ জন বীর উত্তমের মধ্যে এ এন এম নূরুজ্জামান অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ।
    মুক্তিযুদ্ধে এ এন এম নূরুজ্জামান ছিলেন ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। তার সনদ নম্বর ১০।

    এ এন এম নূরুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর রায়পুরার সায়দাবাদ গ্রামে। তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে। এরপর মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমি ও সুনামগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। সুনামগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং সিলেট এম.সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেন।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যায়নকালেই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে গ্রাজুয়েট কোর্সে যোগ দেন তিনি। ১৯৬০ সালের অক্টোবরে কমিশন পান। এরপর তিনি যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হিসেবে ১৯৬৮ সালে এ এন এম নূরুজ্জামানকে বন্দী অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে জেল থেকে ছাড়া পেলেও তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন।

    মুক্তিযুদ্ধের পর এ এন এম নূরুজ্জামানকে পুনরায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালেই পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে তাকে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কর্নেল এবং পর্যায়ক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, সেনেগাল, কানাডা ও সুইডেনে বাংলাদেশ দুতাবাসে কূটনীতিবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
    ১৯৯৩ সালের ১৬ মার্চ সুইডেনে বাংলাদেশ দুতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ এন এম নূরুজ্জামান, বীর উত্তম।

    ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর ঢাকা থেকে বহু বাঙালি ইপিআর, আনসার ও পুলিশ নরসিংদী যান। এ এন এম নূরুজ্জামান ঢাকা থেকে নরসিংদী গিয়ে তাদের একাংশকে সংগঠিত করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নরসিংদীর পতন হলে ত্রিপুরার আগরতলায় চলে যান এ এন এম নূরুজ্জামান। মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে ওঠার পর ৩ নম্বর সেক্টরের সহকারী সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান এ এন এম নূরুজ্জামান। জুলাই মাসে ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ মুক্তিবাহিনীর জন্য এস ফোর্স ব্রিগেড গঠন করলে এ এন এম নূরুজ্জামান ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পান।

    ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জের অংশবিশেষ। ৩ নম্বর সেক্টরের আয়তন ছিল ৯ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার। আর মোট সাব সেক্টর ছিল ১০টি। এগুলো হলো পঞ্চবটী, কালাছড়া, মনতলা, বামুটিয়া, বিজয়নগর, বাঘাইবাড়ি, সিমনা, হাতকাটা, আশ্রমবাড়ি ও কলকলিয়া। এই সেক্টরে প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিলেন। এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে অসংখ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এর মধ্যে আখাউড়ার যুদ্ধ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মধ্যে রেল যোগাযোগের জন্য আখাউড়া রেলজংশন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অবস্থান ছিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই। সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা।

    আখাউড়ার বিভিন্ন স্থানে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনীর ২৭ পদাতিক ব্রিগেডের ১২ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্ট ২টি ট্যাংক নিয়ে ছিল এই এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আখাউড়া দখল করতে পারা মানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে বিজয়ের অনেকটুকু এগিয়ে যাওয়া। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী এই অপারেশনের নাম ঠিক করে ‘অপারেশন নাট ক্র্যাক’। এ যুদ্ধে এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের একদল তথা ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়ার উত্তর দিকে ব্লকিং পজিশন তৈরি করে। এর ফলে সীমান্তসংলগ্ন সড়ক ও রেলপথ পাকিস্তানিদের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এস ফোর্সের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা একই দিক থেকে আক্রমণ করেন।

    অন্যদিকে এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা আগরতলা এয়ারফিল্ডের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালায়। টানা ৬ দিনব্যাপী চলা এই যুদ্ধ শেষ হয় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ৫ ডিসেম্বর দুপুরে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।এ এন এম নুরুজ্জামানের নির্দেশে এমন আরেকটি অপারেশন ছিল মুকুন্দপুর অ্যামবুশ। মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখার কারণে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেনের ইঞ্জিনের আগে বালিভর্তি ওয়াগন জুড়ে দিত। এর ফলে মাইন বিস্ফোরণে সামনের ওয়াগন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ট্রেনের ইঞ্জিনের ক্ষতি হতো না। এস ফোর্সের কমান্ডার কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করে এ এন এম নূরুজ্জামান তখন বিশেষ ব্যবস্থা নিলেন। তিনি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন ফাটানোর জন্য বৈদ্যুতিক পন্থা বা ইলেকট্রিক ডিটোনেটিং সিস্টেমের পদ্ধতির আশ্রয় নেন।

    পাকিস্তানি বাহিনী যখন আখাউড়া-সিলেট রেললাইন চালু করার বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠে, তখন এ এন এম নুরুজ্জামান প্রথমে কয়েকদিন তাদের কার্যকলাপ খেয়াল করেন। এরপর তার নির্দেশে মুকুন্দপুর এলাকায় অ্যামবুশ গড়ে তোলা হয়। এই অ্যামবুশটি করা হয়েছিল ২টি অ্যান্টি ট্যাংক মাইন দিয়ে। সেই অ্যান্টি ট্যাংক মাইনের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার সংযুক্ত করে প্রায় ৩০০ গজ দূরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করা হয়, যেন সেখান থেকে সুইচ টিপলে মাইন ফেটে যায়। ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ২ অফিসারের নেতৃত্বে ১ কোম্পানি সেনার ট্রেনে করে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুর যাওয়ার কথা ছিল। মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে মুকুন্দপুর ও হরশপুরের মাঝামাঝি এলাকায়। এই ট্রেনেও নিরাপত্তার জন্য ইঞ্জিনের আগে ২টি ওয়াগন লাগানো ছিল।

    ভোররাত প্রায় ৪টার দিকে যখন পাকিস্তানি ট্রেনটি মুকুন্দপুর থেকে হরশপুরের দিকে যাত্রা করে, তখনই মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ পার্টি সতর্ক হয়ে উঠে। ট্রেন ধীরে ধীরে পার হচ্ছিল। বালিভর্তি ওয়াগন যখন অ্যামবুশ লাইন অতিক্রম করল, ঠিক তখনই এ এন এম নূরুজ্জামানের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের নেতৃত্বে সুইচ টিপে মাইন ফাটানো হয়। ইঞ্জিনবাহী ট্রেনটি বিধ্বস্ত হয়ে এই অপারেশনে ২ পাকিস্তানি অফিসারসহ মোট ২৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সফল এক অ্যামবুশ ছিল কালেঙ্গা জঙ্গলের অ্যামবুশ। এই জঙ্গল ছিল আশ্রমবাড়ি সাব সেক্টরের অধীনে। কালেঙ্গা জঙ্গলের অ্যামবুশেরও পরিকল্পনা করেছিলেন এ এন এম নূরুজ্জামান।

    কালেঙ্গা জঙ্গল ছিল ভারতীয় সীমান্তের কাছে। সিলেটের দিকে এস ফোর্স সেনা পাঠাতো কালেঙ্গা জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। পাকিস্তানি বাহিনী এই খবর জানার পর কালেঙ্গা জঙ্গলে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। এ সময় মেজর এ এন এম নুরুজ্জামানের নির্দেশে কালেঙ্গা রেস্ট হাউজের পাশে কয়েকটি অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন রাখে মুক্তিবাহিনী। একইসঙ্গে ফলাফল দেখার জন্য মুক্তিবাহিনী চরও নিযুক্ত করা হয়। ২০-২১ সেপ্টেম্বরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কালেঙ্গা জঙ্গলে যায়। রেস্ট হাউসের দিকে যাওয়ার সময় তাদের পায়ের চাপে ২টি মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সময় একজন নিহত এবং ২-৩ জন আহত হয়। এরপর পাকিস্তানিরা সিন্দুরখানের দিকে চলে যায়। পরদিন বেশ কয়েকজন মাইন পরিষ্কার করে সেখানে পাকিস্তানি ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিবাহিনী এতে সেদিন বাধা দেয়নি। কারণ এ এন এম নূরুজ্জামানের আরো বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল।

    ২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অ্যামবুশ করার জন্য সিন্দুরখান-কালেঙ্গা রাস্তার উপর ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে মুক্তিবাহিনী। এক সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি তৈরি করতে এলো। তাদের সামনে ছিল ২০-২৫ জন রাজাকারের একটি দল। তারা অ্যামবুশের আওতায় এলেও মুক্তিবাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়নি। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি সেনারা। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। কালেঙ্গা জঙ্গলের এই অ্যামবুশে পাকিস্তানি বাহিনীর এক অফিসারসহ নিহত হয় ৬১ জন পাকিস্তানি সেনা। আহত হয় বেশ কয়েকজন। আখাউড়া যুদ্ধ, কালেঙ্গা অ্যামবুশ ছাড়াও আশুগঞ্জে মেঘনা ব্রিজ ধ্বংস, চান্দুরার যুদ্ধ, কালাছড়া চা বাগানের যুদ্ধ, ধর্মগড় বিওপির যুদ্ধ, বিটঘর-পানিশ্বর যুদ্ধ, খোয়াই ব্রিজ ধ্বংস, মুকুন্দপুর ও আমিরগঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, মুকুন্দপুর বিওপি আক্রমণসহ বহু যুদ্ধের নকশা ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন এ এন এম নূরুজ্জামান।

    তথ্যসূত্র:
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড বাংলাপিডিয়া
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ৩

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ