• রাজশাহী বিভাগ

    সিরাজগঞ্জে পাঁচ বিঘা জমি বেচে একটি রেডিও কিনলেন

      প্রতিনিধি ২০ মে ২০২৩ , ৩:৪৯:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    মোঃ লুৎফর রহমান লিটন-সলঙ্গা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ

    সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার রহিমাবাদ গ্রামে প্রায় ৫৭ বছর আগে বাবার কেনা রেডিও হাতে ছেলে আলতাফ হোসেন। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার রহিমাবাদ ঘটনা ১৯৬৫ সালের! দেলোয়ার হোসেন মিঞা পাঁচ বিঘা জমি বেচে একটি রেডিও কিনলেন। আর ব্যাটারি কেনার জন্য বিক্রি করলেন আরও এক বিঘা জমি। অভাবের তাড়নায় সাত বছরের মাথায় আবার শখের সেই রেডিও বিক্রি করে দিলেন। তাঁর ছেলে আলতাফ হোসেন বাবার স্মৃতি হিসেবে ৫০ বছর পরে ২০২২ সালে সেই রেডিও বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছেন।

    অর্ধশতাব্দীর বেশি পুরোনো রেডিও দেখতে অনেকে এখন ভিড় করছেন আলতাফ হোসেনের বাড়িতে। কিন্তু তিনি রেডিও বাজাতে পারছেন না। রেডিওটি চালু করতে একসঙ্গে আটটা ব্যাটারি লাগে। এর দাম প্রায় ৪০০ টাকা। কিন্তু ওই টাকা খরচের সামর্থ্যও এখন নেই আলতাফের। কারণ, শখের মূল্য দিতে গিয়ে বাবা তাঁদের নিঃস্ব করে গেছেন। রেডিওটার গায়ে লেখা আছে নিপ্পন ইলেকট্রনিক কোম্পানি লিমিটেড, জাপান।

    বাবার সেই কাহিনি বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠে আলতাফের। বাবা দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার রহিমাবাদ গ্রামে। গ্রামটি এখন নতুন থানা সলঙ্গার ভেতরে পড়েছে। তাঁর বড় ছেলে আলতাফের বয়স এখন ৬৬। তিনি মানুষের বাড়িতে রাখালের কাজ করেন।

    ১৯ মে রহিমাবাদ গ্রামে আলতাফ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি একটি ফুল তোলা রঙিন পাঞ্জাবি, পায়জামা আর সুন্দর চটি পরে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়েছেন। তাঁকে দেখেই হীরক রাজার দেশে সিনেমার রাজার জামাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তবে কথাবার্তার শুরুতেই বোঝা গেল তিনি ভীষণ সরল-সোজা মানুষ। সুন্দর পোশাক-আশাকের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার আগেই তিনি বললেন, এ পোশাক রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম কিনে দিয়েছেন। যোগাযোগ করলে চেয়ারম্যান বলেন, জমি বিক্রি করে রেডিও কেনার ঘটনা ঠিক। তাঁর বাবাই সব জমিজিরাত বিক্রি করে গেছেন। তাঁর ছেলেদের আর কিছু নেই। তবে আলতাফ খুব সৎ মানুষ। সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। তাঁর স্ত্রী চায়না খাতুন তাঁর পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য। সততার সঙ্গে কাজ করেন।

    আলতাফ হোসেন বললেন, তাঁর বাবা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে পাবনা থেকে ২৫০ টাকায় জাপানি তিন ব্যান্ডের আট ব্যাটারির রেডিও কিনে আনলেন। তখন জমিও সস্তা ছিল। ৫০ টাকা বিঘা। একসঙ্গে রেডিওতে আটটা ব্যাটারি লাগাতে হতো। একসেট ব্যাটারি সারাক্ষণ বাজালে ২৪ ঘণ্টা চলত। বাবা দুলাল কুন্ডুর দোকান থেকে কার্টন ধরে ব্যাটারি কিনে আনলেন। তার জন্য আরেক বিঘা জমি বিক্রি করলেন। সেই জমির দাম এখন এক কোটি টাকা। আলতাফ হোসেন তোতা পাখির মতো সেই গল্প বলে যান। ‘আমি বাপের বড় ছেলে ছিলাম। সারাক্ষণ রেডিও ধরেই থাকতাম। তখন নিনা হামিদ, আব্বাসউদ্দীন, আব্দুল আলীমের গান! এ অঞ্চলে আর কোনো রেডিও ছিল না। শত শত মানুষ রেডিও শুনতে আসত। বাবা তাদের তামাক আর পাতার বিড়ি কিনে দিতেন। তারা বসে হুক্কা টানত, বিড়ি খেত আর গান শুনত। এরপর ’৭০–এর নির্বাচন, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, যুদ্ধের খবর মানুষ বসে থেকে শুনছে। বাবা তোতা খলিফার কাছ থেকে রেডিওর একটা জামা তৈরি করে এনেছিলেন। তোতা খলিফা এখনো বেঁচে আছেন। সব কথা জানেন।’

    আলতাফ হোসেন বলেন, বাবার শখের শেষ ছিল না। এলাকার মানুষ যা চাইতেন, বাবা তা–ই দিতেন। সবাইকে খুশি করতে গিয়ে একসময় পৈতৃক ২৬ বিঘা জমি শেষ হয়ে গেল। ১৯৭২ সালে রেডিওটাও ১৮০ টাকায় বিক্রি করে দিলেন। আলতাফ বললেন, ‘তখন আমি চিক্কর দিয়া উঠলাম। কইলাম বাবা, জমিও গেল, রেডিও গেল! বাবা আমাক সান্ত্বনা দিয়ে কইলেন, আবার কিনে দিব।’

    রেডিও বিক্রির আগে আলতাফ হোসেনের বাবা ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়িও বিক্রি করেন। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। আলতাফ পাশের বনবাড়িয়া গ্রামের রহমান মাস্টারের বাড়িতে রাখালের কাজ করেন। তাতেও তাঁর কোনো দুঃখ নেই। তাঁর মন পড়ে থাকে রেডিওর কাছে। স্থানীয় জিল্লার খন্দকার নামের এক ব্যক্তি রেডিওটি কিনেছিলেন। তিনি দিনে দুবার করে তাঁর বাড়িতে যান। কিছুতেই তাঁরা দিতে চান না। ২০১০ সালে জিল্লার খন্দকার মারা গেলে রেডিওটা তাঁর ছেলে আমজাদের কাছে ছিল। তাঁর কাছে গেলে তিনি বলতেন বাবা মারা যাওয়ার আগে কোথায় রেখে গেছে জানেন না। তবু হাল ছাড়েন না আলতাফ। তাঁর এই রেডিওপ্রীতি দেখে ২০১৪ সালে উল্লাপাড়া উপজেলার পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান মারুফ বিন হাবিব এক ব্যাটারির ছোট একটা রেডিও কিনে দেন।

    পাশের চেংটিয়া গ্রামের নির্মাণশ্রমিকের সহকারী হাবিবুর আলী শেখ (৬৮) আলতাফ হোসেনদের বাড়িতে কাজ করছিলেন। পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে রেডিও কেনার বিষয়টি তিনিও জানেন। তিনি বললেন, তখন তাঁর পুরো জ্ঞান হয়েছে। আলতাফ হোসেনের বাবা রেডিও কিনে আনলেন। গ্রামের শত শত মানুষ এসে সেই রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছেন, গান শুনছেন—এসব তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।

    গত বছর ২৬ জানুয়ারি সকাল সাতটায় ৫০০ টাকার একটা নোট নিয়ে তিনি আমজাদের কাছে গিয়ে অনুনয় করে বলেন, রেডিওটা ফেরত না দিলে আপনার বাবা কবরে কষ্ট পাবেন। এ কথা শুনে টাকা ছাড়াই আমজাদ তাঁর হাতে রেডিওটি তুলে দেন। আলতাফ হোসেন বলেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে তিনি রাখালি করছেন। সারা জীবন শুধুই কষ্ট। এ জন্য বিয়ে করতেও দেরি হয়েছে। সবে মেয়েটা এইচএসসি পাস করেছে। ছেলেটা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এখনো রাখালিই করছেন। সংসারই চলে না। বাবার রেডিওর সেই আওয়াজ ভুলতে পারেন না। মন চায় রেডিওটা বাজাতে। আটটা ব্যাটারির দাম এখন ৪০০ টাকা। বিদ্যুতে শুনবেন, তার জন্য মিস্ত্রির কাছে নিতে হবে। সে সামর্থ্যও তাঁর নেই। বলতে বলতে আলতাফ হোসেন রেডিওটা বুকের কাছে ধরেন। তাঁর চোখ ভিজে ওঠে।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ