• ঢাকা বিভাগ

    সমাজে এই বর্বরতা কোথা থেকে আসছে?

      প্রতিনিধি ২৭ জুন ২০২২ , ৮:৪৮:৩৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    আশুলিয়ায় এক কলেজ শিক্ষককে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে দশম শ্রেণির এক ছাত্র। বিভিন্ন সময় শাসন করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওই বখাটে ও উচ্ছৃঙ্খল (?) ছাত্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিষয়টিকে আমি বর্বরতার চেয়ে ছোট করে দেখতে রাজি নই এবং এর কারণ কী, তা একটু আলোচনা প্রাসঙ্গিক।এখন থেকে ১০, ১৫ বা ২০ বছর আগের স্মৃতি মনে করুন। কলেজ পর্যন্ত যেতে হবে না— প্রাইমারির স্মৃতি কী বলে? আমরা শিক্ষক দেখলে দূর থেকে রাস্তা ছেড়ে দিতাম-দিই।

    সাইকেল বা মোটরসাইকেলে থাকলে সেটা থামিয়ে নেমে পড়তাম, এখনও নেমে পড়ি। আমরা পড়া না পারলে বা কোনো ভুল করলে শিক্ষক হাত পাততে বলতেন, হাত পাতলে বেত মারতেন। কিন্তু পরে যখন শিক্ষকের হাতে ব্যাগ বা ভারী কিছু দেখতাম তখন বেতের বাড়ি খাওয়া সেই হাত দিয়েই সেটা বহন করে দিতাম। এই সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কোথা থেকে আসতো বা আসে? শুধু শিক্ষক নয়, পরিবার বা সমাজের সব গুরুজনের ক্ষেত্রে একই শিক্ষা আমরা পেয়েছি।

    এমনকি কোনো সম্পর্ক যদি না-ও থাকে, তবুও শুধু বয়সে সিনিয়র হলেই তার জন্য সম্মান বরাদ্দ। তাহলে হঠাৎ করে আমাদের শিক্ষার মধ্যে কী ভূত ঢুকেছে, যে সবকিছু উল্টে গিয়ে এক বর্বর সমাজ গড়ে উঠছে? সমাজের সম্মানের জায়গা থেকে শিক্ষকদের ছুড়ে ফেলার এই চিত্র কয়েক বছর ধরে আমাকে ভাবিয়েছে।

    প্রথমত:
    প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লাঠি বা বেতের ব্যবহার বন্ধ করা। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে মুখে পশ্চিমাদের অনুদান দেওয়া দু’খানা বিস্কুট দিতে গিয়ে তাদের ভাবিষ্যত অন্ধকার করে ফেলেছি। পশ্চিমা সমাজে পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনব্যবস্থা নেই। তারা তাদের সমাজের মতোই পরামর্শ-শর্ত দিয়েছে। সেই শর্ত মেনে আমাদের সন্তানদের শাসন করার অধিকার থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করেছি। শিশু-কিশোর বয়সে তারা গুরুজন-বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করার যে প্রশিক্ষণ পেত, তা বন্ধ করে দিয়েছি। পেটানোর বিষয়ে অনেকে একমত হবেন না। কিন্তু আপনাকে আপনার জাতিগত ক্যারেকটার বিবেচনায় নিয়ে চরিত্র গঠনের উপাদান ঠিক করতে হবে। জাতি হিসেবে আমরা কেমন, সেটা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরের অবস্থা দেখে নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন। এখানে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা ছিল বা আছে। কোনো শিক্ষক ছাত্রকে পেটালে একসময় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। ওই শিক্ষকের সমাজ, সম্মান, রুজি, জীবন—সবকিছু শেষ করে দিয়েছি। কারাগারে পাঠিয়েছি।

    দ্বিতীয়ত:
    আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কিছু বিষয় সরিয়ে ফেলা হয়েছে, যা মারাত্মক ক্ষতি করেছে। যেমন, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’। বাদশাহ আলমগীরের ছেলে একদিন শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছে এবং শিক্ষক পায়ের ধুলা ধুয়ে ফেলছেন। এই দৃশ্য বাদশাহ দেখেছেন। শিক্ষক ভয়ে আছেন তার কী পরিণতি হয়। বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে বললেন, ‘শুনুন জনাব তবে, পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে? বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা, নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা।…সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে, নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন, পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ। নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে, ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।’ ছেলে কেন শিক্ষকের পায়ে শুধু পানি ঢালছে, কেন হাত দিয়ে পা ধুয়ে দিচ্ছে না, এটা দেখে বাদশাহ মনে ব্যথা পেয়েছেন। আপনি-আমি কোন বাদশাহ, যে আমার ছেলেকে শিক্ষক পেটাতে পারবেন না? আমাদের কারিকুলাম থেকে এই কবিতাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে কেন আমরা শিক্ষকের মর্যাদা আসা করছি?

    তৃতীয়ত:
    সরকার বা সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করুক আর না করুক, এটাই সত্য যে, গত কিছু বছরে দেশের মফস্বল থানা, ইউনিয়ন থেকে গ্রামে গ্রামে মাদক ছড়িয়েছে। ১০-১৫ বছর আগে গ্রামের মানুষ মাদক চিনতই না। এখন আপনি গ্রামে ইয়াবা পাবেন। দেশজুড়ে এত এত মাদক কীভাবে সাপ্লাই হয়, কারা দেয়, কারা আমদানি করে, কারা উৎপাদন করে? মাদক এখন এত সহজলভ্য যে, কিশোররাই এখন বেশির ভাগ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সমাজটা গিলে ফেলেছে মাদকে। এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র।

    রাজনীতি:
    শিক্ষক নির্যাতনের সাম্প্রতিক অনেক ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকরা এখন রাজনৈতিক ছাত্রদের ভয় পান। কারণ, আমাদের ছাত্র রাজনীতির সিস্টেমটা ‘বড় ভাই’ বা ‘জি ভাই’ স্টাইলের। ভাইকে খুশি রাখলে যা ইচ্ছা করা যায়, ভাই সবকিছু দেখেন। ফলে শিক্ষকের চেয়ে ভাই গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতাশালী ও বড়। তুমি যা ইচ্ছা করবে কিন্তু তোমাকে কেউ শাসন করার ক্ষমতা বা অধিকার রাখে না। তাহলে কিশোর-তরুণদের আমরা কোন পথে ঠেলে দিলাম?

    বাংলাদেশে অবহেলিত শ্রেণির মধ্যে শিক্ষকরা অন্যতম। একজন দিনমজুরের চেয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকের বেতন কম। কিন্তু তাদেরকে অন্তত সম্মানটা দিতে হবে। যে সমাজে শিক্ষক তার ছাত্রকে শাসন করার অধিকার হারায়, ছাত্র শিক্ষকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পেয়ে যায়, হাত বাড়ালেই মাদক পেয়ে যায়, গুরুজনকে সম্মান করা শেখার উপাদান সরিয়ে ফেলা হয়, সেই সমাজ বর্বর কেন হবে না?

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ