সাংবাদিকতায় আর আগের মতো ধার নেই, সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে, কোনোকিছু লিখলেও কাজ হয় না-প্রায়ই শুনতে হচ্ছে এ অভিযোগ। শুনতে হচ্ছে এখন আর কাগজ পড়াই যায় না। ভুলে ভরা, যাচ্ছেতাই হাবিজাবি দিয়ে কাগজ ভরে দিচ্ছে। সংবাদপত্র-সাংবাদিকতা তথা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
বরং উল্টো করে বলা হয় যতোসব বাজে অভিযোগ। কী নেই সংবাদপত্রে? আগে শুধু সংবাদ থাকতো। এখন সংবাদের সঙ্গে সংবাদ বিশ্লেষণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সিনেমা, ফ্যাশন, আইটি, রান্নাবান্না কতো কী দেয়া হচ্ছে! এমনকি ছাত্রদের নোট পর্যন্ত। পাঠক আর কী চায়? আগে পত্রিকা ছিল আট পৃষ্ঠার। এখন ষোল, বিশ, বাইশ, চব্বিশ পৃষ্ঠার।
শুধু তাই নয়, পত্রিকার সঙ্গে বিনামূল্যে একাধিক ম্যাগাজিন, যা আগে কেউ কোনোদিন কল্পনাই করতে পারতো না। তারপরও অভিযোগ-সংবাদপত্রে কিছু নেই, কিছুই থাকে না। কিন্তু তারপরও বিষয়টা বিবেচনার দাবি রাখে। তাই এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও অনুসন্ধান জরুরি। প্রথমেই অনুসন্ধান করা দরকার কেন এ অভিযোগ।
এ বিষয়ে যতোদূর জানা গেছে তা হলো আগের দিনে সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে সর্বত্র তোলপাড় হতো। ঘুষ, দুর্নীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন। কিন্তু আজ, আজ কোনোকিছু নিয়ে লিখলে তোলপাড় হয় না, বরং তা নিয়ে নানান প্রশ্ন, সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়। একসময় সংবাদপত্রের লেখনি জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতো। কিন্তু এখন কোনো প্রভাবই ফেলে না।
এ অবস্থায় কেউ যদি অভিযোগ করে সংবাদপত্র-সাংবাদিকতায় আগের ধার নেই, নেই সেই লেখনি-তা কি অস্বীকার করা যায়? না, যায় না। সত্যি বলতে কি ষাট-সত্তর দশকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ যেভাবে জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতো এখন তার ছিটেফোঁটাও হয় না। বরং প্রকাশিত সংবাদ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে নানান কটাক্ষ, নেতিবাচক কথা হয়। আবার অনেকে বলেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে সংবাদপত্রের প্রভাব কমবে এটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে দেখে ফেলছে।
জেনে যাচ্ছে। তাই সংবাদপত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখা সংবাদ পরদিন সংবাদপত্রে দেখলে তা তো বাসি পানসেই মনে হবেই। অতীতে যা সংবাদপত্রে তরতাজা খবর ছিল এখন তা ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল টেলিভিশনে চলে গেছে। কিন্তু না, এটা কোনো কারণ নয়।
যদি তাই হতো তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে সংবাদপত্র উঠে যেতো। কারণ ওইসব দেশে টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি, সেই তুলনায় আমাদের দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ভারতে তিন শতাধিক চ্যানেল আছে। অথচ সেই ভারতে সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত বছর ভারতে সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। অথচ আমাদের দেশে এ সংখ্যা বাড়ছে না। উপরন্তু সংবাদপত্রের প্রতি মানুষ হতাশ। মানুষ যে হতাশ তা তাদের অভিযোগ থেকেই স্পষ্ট। প্রশ্ন হলো এ অবস্থা কেন হচ্ছে? এ বিষয়ে যতোদূর মনে হয়, তা হলো বিগত দুই দশকে এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হলেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন হয় নি, বরং অবনতি হয়েছে।
এ অবনতির কারণ সংবাদপত্রকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা। এ সময় অধিকাংশ পত্রিকায় পেশাদার সম্পাদকের পরিবর্তে আমরা দেখেছি মালিক-সম্পাদক। নয়তো আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদক। এ মালিক ও আজ্ঞাবাহী মাফিয়া সম্পাদকরা প্রথমেই সচিবালয়ে অবাধ যাতায়াতের অধিকার নিশ্চিত করেছে। সেই সঙ্গে গণভবন, বঙ্গভবন, এম্বাসিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুবিধা নিশ্চিত করেছে।
তারপর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। এর মধ্য দিয়ে আজ্ঞাবাহী মাফিয়া ও মালিক-সম্পাদকরা সংবাদপত্র নয়, তারা তাদের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে। সংবাদপত্র মালিকরা যদি তাদের অন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় তাতে আপত্তির কিছু নেই। বরং এ ক্ষেত্রে খুশী হবার কথা। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার মানেই কর্মসংস্থান।
কিন্তু না, বিষয়টা এখানে সীমাবদ্ধ নয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব যেমন আছে তেমনি সাংবাদিকতায় এর প্রভাব পড়েছে তাৎক্ষণিক, যার পরিণতি হিসেবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মালিকরা সরাসরি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত বলে সংবাদপত্রগুলোতে সাংবাদিকতার পরিবর্তে মালিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা ও প্রসারের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে।
শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষতা আর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিকতার নামে এখন মিথ্যাচার আর নির্লজ্জ দালালি চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় জয়ের জন্য কতিপয় সাংবাদিক নামধারী সংবাদপত্রে কর্মরত সম্পাদক থেকে শুরু করে সহসম্পাদক, রিপোর্টার কমবেশি সবাই যাচ্ছেতাই লিখে যাচ্ছে।
এতে পাঠক শুধু বিভ্রান্তই হচ্ছে না, নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। কারণ চাটুকারিতা করার জন্য প্রায়ই তথ্য বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করতে হয়। এরপর আছে প্রকৃত তথ্য গোপন। ফলে পাঠক সংবাদপত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ জন্য শুধু মালিক, সম্পাদক বা তাদের খাস নিয়োগকৃত লোকই নয়, এ জন্য অনেক পেশাদার সাংবাদিকও দায়ী।
কারণ বিগত দু’দশকে সাংবাদিকদের মনমানসিকতায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে সাংবাদিক মানে একজন আদর্শ নীতিনিষ্ঠ সাহসী ব্যক্তিত্বকে বোঝাতো। কিন্তু এখন বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। এখন সাংবাদিকতায় আদর্শের কোনো বালাই নেই। সাংবাদিকরা অনেকেই এখন রাতারাতি ধনী হবার প্রতিযোগিতায় নেমে ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি করেছে।
এ প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যে কেউ কেউ কোটিপতি পর্যন্ত হয়েছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, অতীতে সংবাদপত্রে সাংবাদিক কর্মচারী কেউ দুর্নীতি করলে, অর্থের বিনিময়ে নিউজ করলে, নিউজ প্রকাশ বন্ধ করলে অথবা অন্য কোনোভাবে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো। আজকের বাস্তবতা হলো, যে সাংবাদিকদের গাড়ি আছে, দামি ফ্ল্যাটে থাকে কর্তৃপক্ষ তাদেরই গুরুত্ব দেয় ও যোগ্য বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে আমার একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি।
আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমি একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত। একদিন আমি অফিসের নীচতলায় গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছি, এ সময় আমাদের এক মহিলা রিপোর্টার তার প্রাইভেট কার নিয়ে ঢুকলো। আমার পাশে দাঁড়ানো চ্যানেলের চেয়ারম্যান (মালিক) বললেন, মাহবুব ভাই, রিপোর্টাররা নিজের গাড়ি নিয়ে অফিসে আসছে-এটা দেখতে দারুণ লাগে। এই না হলে রিপোর্টার? এতো বছর সাংবাদিকতা করে কী যে করলেন! এটা বলতেই আমি হাসতে হাসতে বললাম, তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আপনি কি জানেন ওর বেতন কতো? না, তা ঠিক জানি না।
আমি বললাম, আমি জানি। ওর বেতন... টাকা। এ বেতনে গাড়ী মেনটেন করে কী করে। তবে এ জন্য অবশ্যই সে কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। মজার ব্যাপার, কর্তাব্যক্তির এ থেকে যেখানে সতর্ক হবার কথা, তা না হয়ে তিনি এসব ব্যাপারকে উৎসাহিতই করছেন। একদিন তো বলেই ফেললেন, আপনি যে অনুষ্ঠানটা করছেন এর টাকা তো অংশগ্রহণকারীদের থেকেই তোলা যায়।
আমি হতভম্ব, বলে কী! বললাম, তা কী করে হয়! এতে কি কোনো ভাবমূর্তি থাকবে? ভদ্রলোক আমাকে বলেন, ওদের যে লাভ হচ্ছে তার জন্য কিছু দেবে না? এতে দোষের কী আছে? এই যখন মালিক কর্তৃপক্ষের অবস্থা তখন সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। এর আগেও আমি দেখেছি একজন সাংবাদিক তার বেতনের চাইতেও বেশী টাকা খরচ করে শুধু বাড়ী ভাড়ায়।
কর্তৃপক্ষ জেনেও কোনোদিন প্রশ্ন তোলেনি-ওই সাংবাদিক চলেন কী করে? অথবা যখন সর্বমোট চৌদ্দ হাজার টাকা বেতনের কোনো সাংবাদিক অফিসে প্রকাশ্যে বলেন সংসার খরচের জন্য বউকে আঠারো হাজার না দিলে ঘরে ঢুকতে পারবো না, তখন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে গর্ব করে বলে, খরচ না করলে কেউ আয় করতে পারে না। কিন্তু সেই আয় কী-এ প্রশ্ন যদি কেউ কোনোদিন করে? এই যখন অবস্থা তখন সংবাদপত্র-সাংবাদিকতার কী হাল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতা পুরোপুরি পণ্যে পরিণত হয়েছে।
এরপর আছে মূর্খতা। অতীতে সাংবাদিকতায় আসতো মেধাবীরা। সাধারণত রাজনৈতিক কর্মীরা স্বাধীন পেশা হিসেবে ওকালতি ও সাংবাদিকতা বেছে নিতেন। বিগত দুই-তিন দশকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বেছে নিয়েছেন।
আর সাংবাদিকতায় এসেছে কোথাও চাকরী না-পাওয়া তরুণেরা নেতাদের সুপারিশ নিয়ে নেতাদের কাছে কর্তৃপক্ষের নানান দায়বদ্ধতা আছে, ফলে তরুণদের না নিয়ে উপায় নেই। এভাবে সাংবাদিকতায়-আসা মেধাহীন মূর্খরা দু’লাইন লিখতে না পারলেও সাংবাদপত্রের বড় বড় পদ এদের দখলে। এদের অনেকে প্রকাশ্যে বলে, আমি তো লিখি না, লিখে কী হবে? ভালোই তো আছি। এতোকাল জানতাম, যে সাংবাদিক ভালো লেখেন, বেশী লেখেন এবং যার লেখার ধার যত বেশি তিনিই তত বড় সাংবাদিক, নামকরা সাংবাদিক। কিন্তু আজকের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এ অবস্থায় সাংবাদিকতায় কি ধার থাকে, না থাকতে পারে? তারপর আরো একটা বিষয় আছে তা হলো, সবকিছু সয়ে যাওয়া বা গা-সওয়া হওয়া। আগে সংবাদপত্রে কোনো দুর্নীতির খবর হলে তা নিয়ে হইচই হতো। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি হলে তো কথাই নেই-এনিয়ে চর্চা হতো দিনের পর দিন। হাটে মাঠে ঘাটে। কিন্তু এখন আর তেমন হয় না।
হওয়ার কথাও নয়। কারণ দুর্নীতির খবর দেখতে দেখতে পাঠক দেশবাসী ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গেছেন। কারণ একজন দু’জন নয়, কমবেশি সবাই দুর্নীতি করছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে। জামিন নিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তারের পর মুক্তি পেয়ে জেল গেটে পাচ্ছে ফুলের মালা। কোনো লাজলজ্জা নেই। কোনো অনুশোচনা নেই। চোরের মার বড় গলা, বলছে-সব মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক, দেখে নেবো, এক মাঘে শীত যায় না, ইত্যাদি। এটা সত্য, তারা দেখে নিচ্ছে।
পরের মাঘে অন্য চেহারা, তারা মন্ত্রী-এমপি-মেয়র। এ অবস্থায় সংবাদপত্রের সংবাদ নিয়ে চর্চা হয় কী করে? পাঠকের কি আর চর্চা করার ইচ্ছে থাকে? একই কথা চুরি, ডাকাতি, খুনখারাবির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আগের দিনে একটা খুন হলে, ডাকাতি হলে, ছিনতাই-রাহাজানি হলে, নারী কেলেঙ্কারি হলে খবরের কাগজের বিক্রি বেড়ে যেতো।
সবাই জানতে চাইতো কী হলো? তারপর কী হলো? সর্বশেষ ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর জেনারেল এরশাদের নারী কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশের পর সংবাদপত্রের বিক্রি বেড়ে যায়। বিক্রি বেড়ে যায় এরশাদের দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সময় প্রতিদিন নেতানেত্রী, আমলা, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির খবর বের হলেও এনিয়ে তেমন চর্চা হয় নি।
কারণ পাঠক জানে এসব কিছু না। ক’দিন বাদে এ পত্রিকাই নেতাদের ফুলের মালা দেয়ার ছবি ছাপবে, লিখবে সব মিথ্যা। এই অবস্থায় পাঠক সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখবে কী করে? সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা খুললেই চুরি, ডাকাতি, খুনখারাবির সংবাদ দেখতে দেখতে পাঠক হাঁফিয়ে উঠেছে। শুধু হাঁফিয়ে ওঠে নি, রীতিমতো আতঙ্কিত। কারণ পাঠক জানে, সংবাদপত্র খুললেই তো দেখতে হবে গণপিটুনি আর ক্রসফায়ারে মৃত্যু।
পাঠক এ রকম খবর চায় না। পাঠক সংবাদপত্রে আশার আলো দেখতে চায়, চায় ভরসা। তাই সেই ভরসা, আশার আলো যারা দেখাচ্ছে পাঠকরা তাদের প্রত্যাখ্যান করেনি। তাদের পাঠকপ্রিয়তা বাড়ছে। এটা কিন্তু অতিসাম্প্রতিক কালের অভিজ্ঞতা।
তাই পাঠকদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান না করে তাকে বিবেচনায় এনে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান জরুরি। এছাড়া সংবাদপত্রে ছাত্রদের নোট দেয়ার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তদন্ত জরুরী ও আবশ্যিক কর্তব্য। কারণ বাজারে যেখানে নোট বই নিষিদ্ধ সেখানে সংবাদপত্রে নোট আইনসিদ্ধ হয় কী করে? এছাড়া এটা সংবাদপত্রের দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কি না তাও দেখার বিষয়। আশা করি, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-গোষ্ঠী বিষয়টা বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন। এ বিবেচনার মধ্যে কোনো ভয়ভীতি, লজ্জা নেই।
বরং আছে গৌরব। যে যতোটা সাফল্যের সঙ্গে অনুসন্ধান করবে, করতে পারবে সে ততো বেশী গৌরবান্বিত হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে পাঠক সংবাদপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সারা দুনিয়ায় এ চিত্র ভিন্ন। মাত্র ক’দিন আগে মে মাসে (২০০৯) বাংলাদেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, গত এক বছরে (২০০৮) বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে বেড়েছে বেশী।
এশিয়ার অংশ হিসেবে আমাদের দেশেও সংবাদপত্রের পাঠক বাড়ার কথা, কিন্তু বাড়ে নি। এ ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের যে প্রয়োজন তা আজো করা হয় নি। সর্বোপরি আজো আমাদের দেশে সাংবাদিকতা- রিপোর্টিং-এ তিনি বলেন, আরো বলেন-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধতাও পাঠককে বিশেষভাবে বিরক্ত করছে। কারণ আমাদের নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে আমলা বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে জ্ঞান দেন পাঠক তা আর গ্রহণ করতে চায় না।
কারণ পাঠক ভালো করে জানে, এই নেতানেত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবীরা বলার জন্য বলেন, এ অবস্থা আমাদের সংবাদপত্রের জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার আশু কোনো লক্ষণ নেই। উপরন্তু সংবাদপত্রে জনগণের চিন্তা-চেতনা, দুঃখ-সুখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার যে প্রতিফলন ঘটার কথা তা ঘটছে না। ফলে পাঠকদের ক্ষোভ-দুঃখ হতাশায় পরিণত হবারই কথা। এ অবস্থায় সংবাদপত্রকে চিন্তা-চেতনায় সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে।
পরিবর্তন আনতে হবে এবং পরিহার করতে হবে দাসত্বের মনোবৃত্তি। সেই সঙ্গে চিন্তা-চেতনায় দেশ-জাতি-জনগণকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রাধান্য দিতে হবে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতার ওপর। গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর। এ ক্ষেত্রে এই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যদি হয় পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্যের নিরিখে-তাহলে হবে না।
এটা আসতে হবে সৎ মানসিকতা থেকে। তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা অনেকাংশেই কমে আসবে। মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। আর মানুষের আস্থা ফিরে এলে সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে ‘কিছু হবে না’ এধরনের অভিযোগ আর উঠবে না। ।
E-mil: dailyalokito71sangbad@gmail.com
@বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোক চিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বে-আইনি।
Copyright © 2024 alokito71sangbad. All rights reserved.