• সাহিত্যে

    বৃদ্ধাশ্রমে এক মায়ের জীবন-A71S

      প্রতিনিধি ১০ আগস্ট ২০২২ , ৪:২৭:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ

    আমি বৃদ্ধাশ্রমে আছি আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। ভালই লাগে এখানে।
    নিজের মত করে থাকা যায়।
    মন চাইলে বই পড়ি না হলে গান শুনি।
    কখনো কখনো এখানকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে গল্প করি।
    আমার ভাল লাগে।
    আমি ভাল আছি।
    দুই ছেলে এক মেয়ে আমার।
    বড় ছেলে যাওয়াদ,পেশায় ডাক্তার।
    সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।
    জহির,আমার ছোট ছেলেটা দেশেই থাকে।
    পৈত্রিক ব্যবসা দেখাশোনা করে।
    মেয়েটা ব্যাংকে কাজ করে।
    বন্ধের দিনে আসে আমাকে দেখতে।
    কোন সপ্তাহে আসতে না পারলে রান্না করে পাঠিয়ে দেয়,
    একটু বেশি করেই পাঠায় যাতে করে অন্যদেরও একটু ভাগ দিতে পারি।
    আমি রাজিয়া খানম।
    এভাবেই চলছে আমার জীবন গত পাঁচ বছর ধরে।

    যাওয়াদের বাবা মারা যাবার বছর খানেক পর হঠাৎ করে আমার কার্ডিয়াক-এটাক হয়।
    আমাকে প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
    কি যে সময় গেছে তখন।
    অর্থের অভাব নেই, নেই ইচ্ছার অভাবও।
    অভাব হচ্ছে সময়ের।
    হাসপাতালে সার্বক্ষণিকভাবে একজন থাকা,
    প্রতিনিয়ত ডাক্তারের সাথে কথা বলা,
    এক্সারসাইজ করানো,
    ওষুধ খাওয়ানো সময় ধরে,
    আরো কত কী!
    বাসায় আসার পর আরেক ঝামেলা।
    সার্বক্ষণিক দেখা শোনার জন্য একটা মানুষ কোথায় পাওয়া যায়।
    মেয়েটা অফিস করছে,
    অফিস আর আমাকে সামলে তার নিজের সংসারটা ঠিক খেয়াল রাখতে পারছেনা।
    একদিন শুনলাম,
    জামাই বলছে-মা তো তোমার একার নয়,
    তোমার ভাইদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে।
    খুব স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু কথা গুলো এসে যায়।
    তাই আমি সহজভাবেই নিলাম।

    এরমধ্যে শুনি, ছোট বউমা জহিরের সাথে খুব চিৎকার- চেঁচামেচি করছে।
    নাতির রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে।
    অসুস্থ আমাকে দেখতে আত্নীয়-স্বজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল,
    আবার আমাকেও একটু বাড়তি যত্ন করতে হয়েছে,
    তাই এ কয়দিন বাবা মা কেউই আর ছেলের পড়াশুনা দেখার সুযোগ পায়নি।
    এই ঘরে বাচ্চা মানুষ হবেনা,
    কারন এখানে পড়াশোনার কোন পরিবেশ নাই
    সারাদিন মেহমান, রান্নাবান্না এইসবের মধ্যে বাচ্চা মানুষ হয়!
    বউমার জোর গলা।
    আমি শুনলাম এবং ভাবলাম ,ঠিকইত ।
    আজকালকার এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে হলে বাচ্চাকে শতভাগ সময় দিতে হবে।
    এখান থেকে দশ ভাগও যদি অন্য কোথাও দেয়া হয়, ক্ষতি হবে বাচ্চার।
    আমি অনেক ভেবে দেখলাম।
    বিভিন্ন দিক থেকে ভেবেছি।
    তারপর আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
    ছেলেমেয়েরা বিরোধিতা করেছে।
    বড় ছেলেটা বিদেশ থেকে আসল।
    অনেক কান্নাকাটি করেছিল সে আমাকে এখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।
    মেয়েটা অনুরোধ করেছিল যেন তার সাথে গিয়ে থাকি,
    কিন্তু আমি সবাইকে না করে দিয়েছি।
    আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি।

    -তাহলে মা তুমি আমাদের ভালবাসনা,
    আমাদের আপন মনে করনা,
    তাই আমাদের কারো সাথে থাকতে চাওনা?
    জহির কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
    তার চোখে জল।
    -ভালবাসিরে পাগল,
    অনেক ভালবাসি।
    আর তাই চাই সম্পর্কটা সবসময় এমন ভালবাসাময়ই থাকুক।
    একসাথে থাকা সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রত্যেশা অনেক বেশিরে।
    আর যখন প্রত্যেশা আর প্রাপ্তির হিসাব মিলেনা তখনই সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়,
    পরিবারে অশান্তি বাড়ে।

    -মা, তুমি আমাদের সাথে থাকতে চাওনা,
    আবার আমাদের গ্রামের বাড়িটাত খালিই পড়ে আছে……
    তুমিতো ঐ বাসায়ও থাকতে পারো মা।
    বড় ছেলেটা বলল।

    -সেইত বাসা, সংসার,দায়িত্ব-অনেক তো করলাম।
    এবার একটু নিজের মত থাকি।
    তোদেরও আমাকে নিয়ে টেনশন করতে হবেনা।
    আমারও একা বাড়িতে মরে পড়ে থাকার ভয় থাকলনা,

    -তুমি যাবেই,বুঝতে পেরেছি।
    ঠিক আছে মা,
    বাধা দিবনা আর।
    একটাই অনুরোধ,
    তোমার খরচটা আমাদের দিতে দিও মা।

    -বেশ তো, দিবি।
    মুচকি হেসে জবাব দিলাম।
    এরপরের কাজগুলো খুব দ্রতই গুছিয়ে নিলাম।
    টাকা-পয়সা, সম্পদের যথাযথ বিলি-বন্টন করলাম।

    আমার অংশের সম্পত্তিটুকু নিজের কাছেই রেখেছি,
    নিজের মত ব্যবস্থা করব বলে।
    এ সম্পদ থেকে সমাজের বয়স্কদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা আছে।
    এখানে অনেকেই আছেন যারা ছেলেমেয়েদের সাথে একটু সময় কাটানোর বিনিময়ে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত,
    কিন্তু ছেলেমেয়েদের সময় হয়না,
    বৃদ্ধ বাবা মায়ের সাথে দুদন্ড সময় কাটানোর।
    আবার অনেকে ভাগের মা কিংবা বাবা হয়ে থাকতে চাননা, চলে আসেন এখানে।
    অর্থাৎ একদম নিরুপায় নাহলে কেউ বৃদ্ধাশ্রমে আসাটা চিন্তাই করতে পারেনা।
    অথচ বৃদ্ধাশ্রমে থাকাটা যে জীবনের শেষ বেলায় অনেক ধরনের পারিবারিক জটিলতার বিপরীতে কোন সুন্দর বা সম্মানজনক সমাধান হতে পারে এই ধারনাটাই এখনো সমাজে তেমন গ্রহনযোগ্য নয়।

    যতদিন আমরা মেয়েরা স্বামী, সন্তান পরিবারেরর বাইরে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করব,ততদিন এই বৃদ্ধাশ্রম ব্যাপারটা একটা ঋণাত্মক ব্যাপার হয়ে আমাদের মাঝে থাকবে।

    এখানে সবাই আমাকে হিংসা করে,
    ভালবাসা মিশ্রিত হিংসা।
    বলে, ছেলেমেয়েরা আপনাকে এত ভালবাসে,
    এত তাদের সাথে থাকতে বলে,
    আর আপনি এখানে আশ্রমে পড়ে আছেন।
    আমি হাসি।
    তাদের আমি বুঝাতে পারিনা,
    আমি এখানেই ভালো আছি।
    আমি জানি, আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে অনেক ভালবাসে, অনেক সম্মান করে।
    কিন্তু আমি এটাও জানি, এই ব্যস্ত জীবনে যেখানে দিনের প্রতিটা ঘন্টা হিসাবের, সেখানে আমি তাদের কাছে একটা বাড়তি দায়িত্ব ছাড়া কিছু নই।

    একজন মায়ের জীবন শুধু ছেলেমেদের বড় করে তোলা আর বৃদ্ধ বয়সে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা নয়।
    বড় হওয়ার সাথে সাথে সন্তানদের নিজের জগত তৈরি হয়, নিজের পরিবার তৈরি হয় ।
    তাদের ঘিরেই চলে জীবনের আবর্তন।
    সেইখানে বৃদ্ধ মা বা বাবা তাদের সেই জীবনের অংশ হয়না।
    এটাই সত্য।
    অনেকেই হয়তো এই সত্যটা ধরতে পারেনা কিংবা ধরতে পারলেও না বোঝার ভান করে।
    হয়তো তাদের আর কোন উপায় নেই অথবা তারা যেকোন মূল্যে সন্তানের কাছে থাকার লোভ সামলাতে পারেনা।
    আমি যেকোন ভাবেই হোক এই লোভ সংবরণ করে নিলাম।
    আমি শেষ বয়সটা আমার নিজের মত করে কাটাতে চাই।

    এরপর থেকে আছি আমার ঠিকানায়।
    হ্যাঁ, এখন এটাই আমার ঠিকানা,
    আমি নিজে এই ঠিকানা বেছে নিয়েছি,
    একটু আমি হয়ে বাঁচার জন্য।

    লেখক:
    শিহাব আহম্মেদ
    সম্পাদক-আলোকিত ৭১ সংবাদ

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ