আরিফুল ইসলাম কারীমী-স্টাফ রিপোর্টারঃ
ছাত্রী মুসকান খান- (বি.কম. দ্বিতীয় বর্ষ), মান্ডা, কর্নাটক:
বিবিসির সূচনা বক্তব্য : গত দুই দিনে ভারতের এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে পড়েছে স্যোশাল মিডিয়ায়। যেখানে দেখা যায়, স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে যাচ্ছেন হিজাব পরা এক ছাত্রী, তাকে অনুসরণ করছেন কিছু যুবক। একদল যুবক ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে ছাত্রীটির দিকে এগিয়ে এসে চিৎকার করছে। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রীও ওই ভীড়ের দিকে এগুতে থাকেন এবং হাত তুলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এই ছাত্রীই মুসকান খান।
বিবিসি : সেদিন কলেজে যা হচ্ছিল, আপনি জানতেন এ বিষয়ে কিছু?
মুসকান : না, আমি আগে থেকে কিছুই জানতাম না। সবসময় যেভাবে কলেজে যাই, সেভাবেই গেলাম। ওখানে বাইরে এক গ্রুপ এভাবেই ছিল, তারা বলছিল যে, ‘বোরকা পরে কলেজের ভেতর যাবে না। কলেজে যেতে যদি চাও, তাহলে বোরকা ও হিজাব খুলে ভেতরে যাও। আর যদি তুমি বোরকা পরে থাকতে চাও, তাহলে বাড়ি ফিরে যাও।’
আমি কলেজের ভেতর ঢুকলাম। এরপর ভেবেছিলাম চুপচাপ কলেজের ভেতর চলে যাব। কিন্তু তখন এত স্লোগান চলছিল। ওই দলের সব ‘বোরকা খুলে ফেলো’ ‘বোরকা খুলে ফেল’, ‘জয় শ্রীরাম’ এরকম কিছু বলছিল। তখন আমি আওয়াজ তুলি! ব্যাস!
বিবিসি : এরপর কী হলো?
মুসকান : আমি ভেবেছিলাম আমি ক্লাসে যাব, এরকম বলে। কিন্তু ছেলেগুলো আমাকে এমনভাবে অনুসরণ করছিল যেন তারা সবাই আমাকে আক্রমণের চেষ্টা করছে। তারা ছিল অন্তত ৪০ জনের মতো। আমি ছিলাম একা। তাদের মধ্যে কোনো মনুষত্যবোধ ছিল না। হঠাৎ তারা আমার কাছে এসে চিৎকার করতে লাগলো। তাদের হাতে ছিল কমলা রঙের স্কার্ফ। তারা আমার মুখের সামনে এসে স্কার্ফ দোলাতে লাগলো আর বলতে লাগলো ‘জয় শ্রীরাম’, ‘চলে যাও, বোরকা খুলে ফেলো।’
বিবিসি : আপনি কতদিন ধরে হিজাব পরছেন? কলেজে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল এর আগে?
মুসকান : কলেজে কোনো সমস্যা হয়নি কখনো। সবকিছু আগের মতোই ছিল। আমরা হিজাব পরে ক্লাসে যাচ্ছিলাম। আমরা বোরকা পরি না। শুধু হিজাব পরি। চুল আড়াল করে ক্লাসে যাই। কিন্তু ওই লোকেরা তো আমাকে সেদিন ক্যাম্পাসে ঢুকতেও দিচ্ছিল না। তাদের অনেকেই ছিল বহিরাগত এবং কলেজের ছাত্র ছিল কম। কিন্তু বেশিরভাগই ছিল বহিরাগত।
বিবিসি : ওই লোকগুলো কী বলছিল?
মুসকান : তারা বলছিল বোরকা খুলে ফেল। না হলে তুমি কলেজে যেতে পারবে না। তারা সবাই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। আমার আগে চার মেয়ে এসেছিল। তাদেরকে তো গেটেই আটকে ফেলেছিল। গেট তালাবদ্ধ ছিল। প্রিন্সিপাল আমাদের সাথে ছিলেন। প্রিন্সিপাল, শিক্ষক সবাই আমার সমর্থনে ছিলেন। সেখানে আমাকে রক্ষা করেছে সবাই। ওই মেয়েদের সাথেও ছেলেরা এমন করছিল। ওরা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে গেছিল। পরে আমার সাথে তারা একই কাজ করলো। আমি কাঁদিনি। আওয়াজ তুলেছি।
বিবিসি : আপনি কী বললেন?
মুসকান : আমি বললাম আল্লাহু আকবার। কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভয় পেলে আমি আল্লাহর নাম নিই। আল্লাহর নাম নিলেই আমার সাহস বেড়ে যায়।
বিবিসি : হিজাব সম্পর্কে আপনার মতামত কী? কলেজ যদি বলে আপনি হিজাব পরতে পারবেন না?
মুসকান : কলেজে আমাদের প্রিন্সিপাল নিজেই বলেছেন যে, তুমি হিজাব পরে আসতে পারো। এখন এই বাইরের লোকগুলো এসে তামাশা তৈরি করেছে। প্রিন্সিপাল নিজেই বলেছেন, আগে তোমরা যেভাবে আসতে, সেভাবেই আসো। কোনো সমস্যা নেই।
বিবিসি : আপনার কি মনে হয় হিজাব পরা উচিত?
মুসকান : হ্যাঁ, অবশ্যই পরা উচিত।
বিবিসি : এ বিষয়ে আপত্তি আসলে আপনার মতামত কী হবে?
মুসকান : ভারতের সংবিধানে আমার বিশ্বাস আছে যে, হিজাবের বিপক্ষের এরকম কিছু আসবে না। ইনশাআল্লাহ, আমরা হাইকোর্টের আদেশের অপেক্ষায় আছি।
বিবিসি : এই মুহূর্তে যে হিজাব বনাম গেরুয়া বিতর্ক চলছে, তা কি অন্যান্য ছাত্রদের সাথে আপনার সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে?
মুসকান : স্যার দেখেন, আমি এখানে হিন্দু বা মুসলিম কোনো জাত নিয়ে কিছু বলছি না। আমি শুধু আমার শিক্ষার জন্য, আমার অধিকারের জন্য দাঁড়িয়েছি। আমরা হিজাব পরছি বলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কলেজে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা তো বছরের পর বছর ধরে এটা পরছি।
এটা তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই লোকগুলো এখন এমনভাবে বলছে যে, তুমি যদি এটা (হিজাব) পরে আসো, তাহলে আমরা এটা (গেরুয়া) পরে আসবো। ছেলেরা আমার কলেজের প্রিন্সিপালকে বলছে, সে যদি বোরকা পরে আসে তাহলে আমরাও এসব সরাবো না। গেরুয়া, গামছা এরকম কিছু পরে এসে বলছে, ওরা যদি বোরকা পরে, আমরাও এগুলো পরবো।
এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তারা যেকোনোভাবে আসতে পারে। আমাদের শুধু হিজাব পরার অনুমতি দরকার, ব্যাস। তারা যেভাবেই আসুক না কেন, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের শুধু দরকার শিক্ষা। আমাদের প্রিন্সিপাল আমাদের সঙ্গে আছেন, শিক্ষকরা আমাদের সাথে আছে। বাইরে থেকে এসে কিছু লোক কেবল তামাশা করছে।
বিবিসি : কালকে যদি হাইকোর্ট বলে, আপনি পরতে পারবেন না হিজাব?
মুসকান : বলবে না স্যার। ভারতের সংবিধান কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে যাবে না—এই আস্থা আমাদের আছে।
বিবিসি : স্যোশাল মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে আলোচনা চলছে, অনেকে প্রশংসা করছেন। কী বলবেন এই নিয়ে?
মুসকান : সবাই এত ভালোবাসা দিচ্ছেন, এত সাহস দিচ্ছেন—অনেক অনেক শুকরিয়া।
E-mil: dailyalokito71sangbad@gmail.com
@বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোক চিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বে-আইনি।
Copyright © 2024 alokito71sangbad. All rights reserved.