• Uncategorized

    বিনা অযুতে স্মার্টফোনের স্ক্রীনে কুরআন মাজিদ স্পর্শ করার বিধান লিখেছেন- মুফতি ফরীদুল হক (দা.বা.)

      প্রতিনিধি ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ১০:৫০:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ

    কুরআন মাজিদ আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র কালাম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। তার সম্মান ও মর্যাদা অতুলনীয়। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের ওপর ওয়াজিব হলো তার যথাযথ সম্মান ও আদব বজায় রাখা। আর কুরআন মাজিদের অন্যতম আদব হলো অযু অবস্থায় তা স্পর্শ করা।

    আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- [لا يمسه إلا المطهرون] অর্থাৎ- যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না। (সূরা ওয়াকিয়া, ৭৯ )।

    হযরত আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাযম রাযি. হতে বর্ণিত হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: « لا يمس القرآن إلا طاهر» অর্থাৎ- অপবিত্র ব্যক্তি যেন কুরআনকে স্পর্শ না করে। (ইবনে হিব্বান, ৬৫৫৯)।

    অতএব, অযুবিহীন ব্যক্তি কিংবা জুনুবী (যার ওপর গোসল ফরয) ব্যক্তির জন্যে অযু বা গোসল ব্যতীত কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা না জায়েয। কারণ তাতে কুরআন মাজিদের মান ক্ষুণ্ন হয়। ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রহ. (৫৮৭ হি.) বলেন-

    ولا مس المصحف من غير غلاف عندنا… (ولنا ) قوله تعالى” لا يمسه إلا المطهرون” وقول النبي صلى الله عليه وسلم: «لا يمس القرآن إلا طاهر». ولأن تعظيم القرآن واجب، وليس من التعظيم مس المصحف بيد حلها حدث.
    অর্থাৎ- আমাদের (হানাফী মাযহাব) মতে গিলাফ (আবরণ) ব্যতীত কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা না জায়েয। এ সম্পর্কে আমাদের দলীল হলো, আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র বাণী “যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না”। তদুপরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “অপবিত্র ব্যক্তি যেন কুরআনকে স্পর্শ না করে”। কারণ কুরআন মাজিদের সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখা ওয়াজিব। আর অপবিত্র হাতে তা স্পর্শ করা, তার সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী। (বাদায়েউস সানায়ে, ১/১৪১, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া)।

    অবশ্য হানাফী মাযহাবের স্বীকৃত বিষয় যে, পৃথক গিলাফ বা আবরণের দ্বারা অযুবিহীন ব্যক্তির জন্যে কুরআন কারীম স্পর্শ করা জায়েয। যুগের ইমাম বায়হাকী বিখ্যাত মুফাসসির ও ফকীহ কাযী ছানাউল্লাহ পানিপতি রহ. (১২২৫ হি.) বলেন-

    يجوز مس القرآن وحمله بغلاف متجاف عند أبي حنيفة رحـ . وقال مالك والشافعي رحـ لايجوز مع الغلاف أيضا.
    অর্থাৎ- “পৃথক গিলাফ দ্বারা ইমাম আবূ হানীফা রহ.’র নিকট কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা ও বহন করা জায়েয; কিন্তু ইমাম মালেক রাহ.ও শাফেয়ী রহ. এর নিকট, গিলাফ দ্বারাও স্পর্শ করা না জায়েয”। (তাফসীরে মাযহারী, ৯/১৬৩ মাকতাবায়ে যাকারিয়া)।

    তিনি আরো বলেন- يكره مسه بالكم أو الذيل لأنهما تابعان باليد. অর্থাৎ- বে-অযু অবস্থায় পরিধেয় কাপড়ের আস্তিন বা আঁচল দ্বারাও কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা মাকরুহ। কারণ এ উভয়টি হাতের হুকুমের অধীন। (প্রাগুক্ত)। অবশ্য পৃথক রুমাল বা চাঁদর দ্বারা স্পর্শ করা জায়েয।

    এখন প্রশ্ন হতে পারে, গিলাফ বলতে কী বুঝায়, যা দ্বারা অযুবিহীন ব্যক্তির জন্যেও কুরআন মাজিদ স্পর্শ করা বৈধ ? এ প্রসঙ্গে ফিকহ শাস্ত্রের কিতাবাদি অধ্যয়নে প্রতীয়মান হয় যে, “গিলাফ” বলা হয় এমন পৃথক বস্তুকে যার ভিতরে কুরআন মাজিদ ঢেকে রাখা হয়, চাই তা কাপড় হোক কিংবা চামড়া ইত্যাদির থলে। যেমন-ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রহ. বলেন–

    والصحيح أنه الغلاف المنفصل عن المصحف، وهو الذي يجعل فيه المصحف، وقد يكون من الجلد وقد يكون من الثوب وهو الخريطة، لأن المتصل به تبع له، فكان مسه مسا للقرآن، ولهذا لو بيع المصحف دخل المتصل به في البيع، والكم تبع للحامل، فأما المنفصل فليس بتبع حتى لا يدخل في بيع المصحف من غير شرط.

    অর্থাৎ- “বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে গিলাফ বলা হয়, এমন বস্তুকে যা কুরআন মাজিদ থেকে পৃথক থাকে এবং তার ভিতরে কুরআনকে ঢেকে রাখা হয়। চাই তা কাপড়েরহোক কিংবা চামড়ার থলে। (সুতরাং যে বস্তুটি কুরআন মাজিদের সাথে মিলিত বা সেলাই করা থাকে তা বিশুদ্ধ বর্ণানুসারে গিলাফ নয়)। কারণ মিলিত বস্তুটি কুরআনের অধীন, ফলে তাকে স্পর্শ করা মানে কুরআন স্পর্শ করা।

    অতএব, কুরআন বিক্রয় করা হলে কুরআনের সাথে মিলিত বস্তুটিও বিক্রয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।এবং আ স্তিন হলো বহনকারীরই অধীন। সুতরাং কুরআন থেকে পৃথক বস্তুটি কুরআনের অধীন না হওয়ায় কুরআন বিক্রয়ের সময় শর্ত না করা হলে বিক্রয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না। (বাদায়েউস সানায়ে, ১/১৪১, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া)।

    কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহ্ শাস্ত্রের উপরোক্ত ভাষ্য থেকে মোবাইল ফোনের হুকুমটি সুস্পষ্ট যে, Skin Touch মোবাইলের স্ক্রীনে কুরআন মাজিদের আয়াত দৃশ্যমান অবস্থায় অযুবিহীন ব্যক্তির জন্যে মোবাইলের স্ক্রীনে হাত লাগানো না জায়েয। এবং মোবাইলের স্ক্রীনে হাত দ্বারা স্পর্শ করে পৃষ্ঠা উল্টানো বৈধ হবে না। কারণ মোবাইল ফোনের ওপর যে গ্লাস লাগানো থাকে তা মোবাইলের সাথে মিলিত ও সংযুক্ত। গ্লাসটি পৃথক করা হলে বলা চলে মোবাইলের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তদুপরি বিক্রয়ের সময় উল্লেখ বা শর্ত করা ব্যতীত মোবাইলের গ্লাসটি বিক্রিত বস্তুর অন্তর্ভুক্ত থাকে। এমনকি গ্লাস ছাড়া উক্ত মোবাইলের কোনো মূল্য আছে বলা যায় না।

    অতএব, মোবাইল ফোনের ওপর লাগানো গ্লাসটি আদৌ গিলাফ হিসেবে গণ্য করা চলে না। কারণ, পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে পরিস্ফুট হয়েছে যে, গিলাফ দ্বারা এমন বস্তুই উদ্দেশ্য যা সংযুক্ত ও মিলিত থাকে না; বরং সম্পূর্ণ পৃথক থাকে। অথচ, মোবাইলের গ্লাস মোবাইলের সাথে মজবুতভাবে মিলিত ও সংযুক্ত থাকে। সুতরাং স্কীন টাচ্ মোবাইলের স্ক্রীনে কুরআন মাজিদ দৃশ্যমান অবস্থায় অযুবিহীন ব্যক্তির জন্যে মোবাইলের স্ক্রীনে হাত লাগানো জায়েয হবে না। কারণ তাতে কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। আর এটি স্বীকৃত যে, কুরআন মাজিদের সম্মান ও আদব বজায় রাখা ওয়াজিব।

    উল্লেখ্য যে, মোবাইল যদি Button বিশিষ্ট হয়, তখন অযু ছাড়াও বাটন টিপে কুরআন পড়া ও পৃষ্ঠা উল্টানো জায়েয। যা ইমাম যাইনুদ্দীন ইবনে নুজাইম রাহ. (৯৭০ হি.) এর নিম্মোক্ত ভাষ্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন-

    يجوز للمحدث الذي يقرأ القرآن من المصحف تقليب الأوراق بقلم أو عود أو سكين.
    অর্থাৎ- “অযুবিহীন ব্যক্তি, যে মোছহাফ থেকে কুরআন তেলাওয়াত করছে তার জন্যে কলম, কাঠ কিংবা ছুরি (ইত্যাদি) দ্বারা কুরআন মাজিদের পৃষ্ঠা উল্টানো জায়েয”। (আল বাহরুর রায়েক; ১/২০১-২০২, মাকতাবায়ে রশীদিয়া)।

    তবে বাটন বিশিষ্ট মোবাইলের পর্দায় কুরআন মাজিদ দৃশ্যমান থাকলে অযুবিহীন অবস্থায় গ্লাসের উপর হাত রাখা জায়েয হবে না। যা আল্লামা শামী রহ. (১৩৫২ হি.) এর নিম্মোক্ত ভাষ্য থেকে বুঝা যায়। তিনি বলেন-

    قوله: ومسه أي القرآن ولو في لوح أو درهم أو حائط، لكن لا يمنع إلا من مس المكتوب.
    অর্থাৎ- “কুরআন কারীম যদি কোনো কাঠ, হাড় ইত্যাদির পাত, সাইনবোর্ড বা স্লেট কিংবা রৌপ্যমুদ্রা ও দেয়ালে লেখা হয়, তাহলে বে-অযু ব্যক্তিকে লিখিত অংশ স্পর্শ করা থেকে বারণ করা হবে”। (রদ্দুল মুহতার, ১/৪৮৮, মাকতাবায়ে যাকারিয়া)।

    মোটকথা- কুরআন মাজিদ দৃশ্যমান অবস্থায় মোবাইলের স্ক্রীন অযুছাড়া স্পর্শ না করাই হচ্ছে শরীয়তের তাকাযা ও কোরআন কারীমের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন। মহান আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
    ——————–
    – হযরত মুফতি ফরীদুল হক, ইসলামী আইন গবেষক, মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ