• আইন ও আদালত

    ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত সুষ্ঠু তদন্ত

      প্রতিনিধি ১৩ জানুয়ারি ২০২২ , ৮:১২:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ

    নিউজ ডেস্কড়ঃ

    সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভ প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর সঠিক বিচারের পূর্বশর্ত হলো পক্ষপাতহীন সুষ্ঠু তদন্ত।প্রশ্নহীন নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া সন্দেহাতীতভাবে ন্যায়বিচার করা অসম্ভব। তদন্ত হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ। তদন্তের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অপরাধ ও অপরাধীর স্বরূপ উন্মোচিত হয়। যদিও তদন্ত মানেই অপরাধ প্রমাণ হয়ে যাওয়া নয়।

    কারও দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাওয়াও নয়। তদন্ত হলো বিচারকের জন্য বিচার্য বিষয় নির্ধারণে অপরাধের উপাদান বিশেষ। অনেকটা পথনির্দেশক। তদন্তের ভিত্তিতেই একজন বিচারক বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। বিচারের গতিপথ নির্ধারণে তদন্ত হলো মূল নিয়ামক। সুতরাং তদন্ত কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও আইনের যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সঠিক ও সুন্দর তদন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে ত্রুটিযুক্ত ও অস্বচ্ছ তদন্ত বিচারক ও বিচার প্রক্রিয়াকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

    বাস্তবতা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত কার্যক্রম ও প্রক্রিয়া নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দুর্বল তদন্তের কারণে বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। প্রকৃত অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যায়। আবার নির্দোষ ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন হয়ে নিগৃহীত হয়। কখনো বা একজনের পরিবর্তে অন্যজন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটায়। এর অন্যতম কারণ হতে পারে সহজে তদন্ত সম্পন্ন করার প্রবণতা। উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনার সময় হরহামেশাই শোনা যায়, তদন্তের সহজ পন্থা হলো আসামিকে দিয়ে দোষ স্বীকার করানো।

    আইনের বিধান আছে, শুধু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতেই আসামিকে দণ্ড দেওয়া যায়। এমনকি অন্য কোনো প্রকার সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলেও। শর্ত হলো, স্বীকারোক্তিটি সত্য ও স্বেচ্ছাকৃত মর্মে প্রমাণিত হতে হবে। এজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার অনেক সময় প্রধান লক্ষ্য থাকে আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা। এমনকি এ উদ্দেশ্যে অন্যায় ও নৃশংস পথ বেছে নিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না। রিমান্ডে বর্বরোচিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় মর্মে প্রচার রয়েছে। এসব পদ্ধতির নাকি ভয়ংকর সব নামও আছে।

    এমনকি ‘ক্রসফায়ারের’ পরিবেশ তৈরি করে ভয় দেখানোর অভিযোগও শোনা যায়। তখন নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও জীবনের ভয়ে কেউ কেউ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়। এতে অনেক মামলাতেই মূল অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায়। পরিণামে ন্যায়বিচার ব্যর্থ (miscarriage of justice) হয়। হরহামেশাই এসব খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়। স্বভাবতই জনমনে তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধে।সাম্প্রতিককালে তদন্ত নিয়ে সংশয় সর্বোচ্চ মাত্রা পেয়েছে। ৪ জুলাই, ২০২০ নারায়ণগঞ্জে নিখোঁজ হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দিসা মণি।

    এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা স্বীকার করে, দিসা মনিকে তারা গণধর্ষণ করার পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু মৃত দিসা মণিকে ৪৯ দিন পর জীবিত পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় হাইকোর্টে কয়েকজন আইনজীবী রিভিশন দায়ের করেন (ওই রিভিশনে এ নিবন্ধের লেখক প্রথম পিটিশনার)। রিভিশনে মামলা ও মামলা-পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়। হাইকোর্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জবাব ও প্রতিবেদন চান।

    তাদের প্রতিবেদনগুলো এবং পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ পায়, অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে আসামিদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। উল্লেখিত রিভিশনে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধকরণ বিষয়ে কয়েক দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। শুনানির জন্য বিষয়টি বর্তমানে পেন্ডিং আছে। এর আগে চট্টগ্রামেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৯ সালের ২১ মার্চে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির অগ্নিদগ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় পুলিশ জীবন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ২৬ মার্চ সে আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। স্বীকারোক্তিতে সে বলে যে, লাশটি জনৈক দিলিপ রায়ের।

    সে এবং দূর্জয় নামের একজন মিলে দিলিপকে হত্যা করে। হত্যার পর তারপিন ঢেলে লাশটি পুড়িয়ে বস্তায় ভরে ফেলে দেয়। বিস্ময়কর সত্য হলো, নিহত দিলিপ মে মাসের ৫ তারিখে আদালতের সামনে জীবিত হাজির হয়। এমন ঘটনা গোটা তদন্তব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
    তদন্তের স্বার্থে আইনগতভাবে আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারায় এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত আছে। রিমান্ডে নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ। ম্যাজিস্ট্রেট এ সংক্রান্ত যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে মর্মে সন্তুষ্ট হলে রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। রিমান্ডের আদেশ দেওয়ার সময় আসামির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

    রিমান্ড মঞ্জুরের সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে আসামির শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়। আঠারো বছরের কম বয়স্ক শিশুকে কোনোক্রমেই রিমান্ডে দেওয়ার সুযোগ নেই।আইন রিমান্ডের অনুমোদন দিলেও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়নি। বাংলাদেশ বা কোনো দেশেই রিমান্ডকালীন নির্যাতন আইনসিদ্ধ নয়। ১৯৪৮ সালের ‘মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে’র (UDHR) অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর বা অমানুষিক বা অপমানজনক আচরণ অথবা শাস্তির শিকার করা যাবে না। আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বিচার ও দণ্ড সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের উল্লেখ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদটির ৫ উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ