• আইন ও আদালত

    নৌদুর্ঘটনায় দেড় যুগ ধরে ঝুলছে ১৪৬ মামলা

      প্রতিনিধি ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ , ১:৫৫:৪৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    নিউজ ডেস্ক

    একমাত্র নৌআদালতে ২৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে, বিচারাধীন ১৪৬টি * নিষ্পত্তি ১০৬ মামলা ৮৮টিতে সাজা ও ১৮টিতে আসামি খালাস

    নৌপথে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা-দুই বেড়েছে। এসব ঘটনায় দায়ীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। মামলা হলেও দ্রুত হচ্ছে না বিচার। ফলে বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে মামলা। গত ৯ বছরের মধ্যে চলতি ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯টি নৌযান দুর্ঘটনা ঘটেছে।
    এতে সরকারি হিসাবেই মারা গেছেন ১৪০ জন। বেসরকারি হিসাবে সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া নিখোঁজ হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এ সময়ে কমেছে নৌ দুর্ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তির হার। বাংলাদেশ নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরে দেশের একমাত্র নৌ আদালতে গত ১৮ বছরে দুর্ঘটনাজনিত ২৫২টি মামলা হয়েছে।

    এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৬টির। এর মধ্যে ৮৮টিতে সাজা হয়েছে এবং ১৮ মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন আসামিরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির পর জড়িতরা অল্প সাজাতেই পার পেয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে শুধু আর্থিক দণ্ড দেওয়া হয়। এর অন্যতম কারণ আইনে কঠোর সাজার বিধান নেই।
    এছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, তদন্ত প্রতিবেদনের ত্রুটি, ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আপসসহ আরও কিছু কারণে পার পেয়ে যান দায়ীরা। এসব কারণে নৌপথ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। দেশে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত নৌযান ছিল ১৩ হাজার ৪৮৬টি। এক বছরে ওই সংখ্যা আরও বেড়েছে।
    জানা গেছে, প্রতিটি নৌযান নির্মাণে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এ খাতে যারা ব্যবসা করছেন তারা অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী। তাদের প্রভাবের কারণে গত ৮ বছর ধরে আটকে আছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ আইন সংশোধন কার্যক্রম।
    ওই আইনে নৌ দুর্ঘটনায় সাজা ১০ বছর প্রস্তাব করা হলেও মালিক ও শ্রমিক নেতাদের চাপে তা কমিয়ে আবার পাঁচ বছর করা হয়। তবে আর্থিক দণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো হয়। তবুও এটি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।
    এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পরিবহণ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আইন সংশোধন থেমে নেই। এটি চলছে। ইতোমধ্যে খসড়া আইনটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
    নৌ দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ফেরি ও লঞ্চ দুর্ঘটনার একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি ও নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছি।
    দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে তদন্ত কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে তাদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জানুয়ারিতে নৌযান মালিকদের সঙ্গে বসব। এ খাতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, লঞ্চে আগাম টিকিট কেটে যাত্রীদের উঠতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে সদরঘাটে টিকিট কাউন্টারও তৈরি করেছি।
    নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ বছরের মধ্যে চলতি বছরেই সর্বোচ্চ ৩৯টি নৌযান দুর্ঘটনায় ১৪০ জন মারা গেছেন। সুগন্ধা নদীতেই ১৪ অক্টোবর একটি তেলবাহী নৌযান থেকে তেল সরবরাহের সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
    ওই ঘটনায় ছয়জন মারা গেছেন। ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ সাবিত আল হাসানকে এমকে এল-৩ নামের একটি মালবাহী জাহাজ ধাক্কা দেয়। ওই ঘটনায় লঞ্চটি ডুবে ২৬ জন মারা যান। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। মামলা চলমান।
    ৩ মে মাওয়ায় পদ্মা নদীতে স্পিডবোট একটি মালবাহী নৌযানের ওপর উঠিয়ে দিলে সেখানেও ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি নিবন্ধনহীন ট্রলার দুর্ঘটনায় মারা যান ২২ জন। একইভাবে অন্যান্য দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১২ সালে ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৬৩ জন মারা গিয়েছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে রোববার পর্যন্ত ৬৪১টি দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৮৭৫ জন মারা গেছেন।
    দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ার কারণ হিসাবে আইন অমান্য করা ও দৃষ্টান্তমূলক সাজার নজির না থাকাকে অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আইন ও বিধি কম মান্য করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
    দুর্ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে পারলে এসব ঘটনা কমে আসবে। তিনি বলেন, একটি সংস্থার পক্ষে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার মামলা অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
    নৌ দুর্ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত কঠোর সাজা হলে তা কমে আসবে বলেও মনে করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক।
    এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর মূল কারণ হলো নৌযান মালিক-শ্রমিকদের অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাব। এ কারণে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা বাড়ছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে নৌপথে নৌযানের সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় যারা দায়ী তাদেরকে শাস্তি দিলে তা অনেকটা কমে আসবে।
    এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নৌ দুর্ঘটনায় একমাত্র নৌ আদালতে ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২৫২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৬টি। এতে ৮৮টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়। ১৮টিতে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
    বর্তমানে মামলা চলমান রয়েছে ১৪৬টি। চলতি বছরে ২৮টি মামলা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২০ সালে মামলা হয় ৩০টি। ২০১৯ সালে মামলা হয় ২৪টি। গত ৩ বছরে মোট মামলার সংখ্যা ৮২টি। এর মধ্যে মাত্র একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
    জানা গেছে, ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় হওয়া মামলা দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত হয়ে আছে। ওই ঘটনায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়।
    মামলা ঝুলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের সাবেক প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা পারভীন সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখেছি, অনেক কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেশি লাগছে।
    এর বড় কারণ হচ্ছে, মামলার সাক্ষীদের আদালতে সঠিক সময়ে হাজির করা হয় না। অনেক সময়ে সাক্ষীদের কাছে আদালতের সমনও পাঠানো হয় না। এছাড়া নৌদুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তদন্ত কমিটিতে যারা থাকেন তাদের আইন।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ