নিউজ ডেস্কঃ
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ক্যাম্পের মাদ্রাসায় ছয় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের প্রশাসনের হাতে ধরা পড়া ঠেকাতে ভয়ংকর প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে মিয়ানমারভিত্তিক বিতর্কিত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।হত্যায় অংশ নেওয়াদের গোপনে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিচ্ছে সংগঠনটি। রোহিঙ্গাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও অডিও থেকে এবং বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, আরসার বাংলাদেশের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে পরিচিত দুর্র্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদ হাসিমকে মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) গভীর রাতে পিটিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সংগঠনটির একটি অংশ। টেকনাফের শালবাগান ক্যাম্পের পাহাড়ে তাকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়।
এ ছাড়া আরও পাঁচ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে নিয়ে হত্যা করেছে আরসার সন্ত্রাসীরা। তবে পুলিশ বলছে, হাসিমকে হত্যার বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা গেলেও এখনো (বৃহস্পতিবার বিকাল) তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু হাসিম মারা গেছেন-এ খবর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ রোহিঙ্গারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বলে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে অন্য সূত্র বলছে, অন্য পাঁচজনকে হত্যা রোহিঙ্গাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা যে কোনো সময় ক্যাম্পে আরও বড় দুর্ঘটনার আতঙ্কে রয়েছেন।
হাসিমকে গলা কেটে হত্যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গানিয়ন্ত্রিত একাধিক গ্রুপে শেয়ার করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের প্রথমদিকে হাসিমকে ধরে নিয়ে যায় তারই সংগঠনের অন্য সদস্যরা। সূত্র দাবি করেছে, হাসিম মুহিবুল্লাহ হত্যা ও ছয় খুনের মিশন বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম একজন। আরসার আমির আতা উল্লাহ জুনুনির সঙ্গে হাসিমের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তিনি আরসার সব অপকর্ম সম্পর্কে জানতেন। প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে তা ফাঁস হতে পারে এ শঙ্কায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে আরও কয়েকজন নেতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন আতা উল্লাহ জুননি।
চলতি সপ্তাহে মিয়ানমার ভূখণ্ডে নিয়ে যে ৫ জনকে একই কায়দায় হত্যা করেছে আরসার সন্ত্রাসীরা তার মধ্যে তিনজনের নাম জানা গেছে।এরা হলেন আবদু সালাম, মোহাম্মদ কামাল ও ইদ্রিস। পাঁচজনেরই পরিবার এখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে। হত্যার শিকার এসব রোহিঙ্গাদের ছবি ও ভিডিও একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাদের হত্যার পর এক অডিও বার্তায় আরসার আমির আতা উল্লাহ জুনুনি কাকে যেন ইঙ্গিত করে বলেন, ডাকাত কি জন্য নামিয়ে দিয়েছ?ডাকাত নামালে, সন্ত্রাস নামালে, ক্যাম্পে ভিডিও করলে (আরসার কার্যক্রম) এভাবে হরিণ মরার মতো মরে। তোদের বুদ্ধি এত কম? আমাদের বিরুদ্ধে পাঠালে পরিস্থিতি এমনই হয়। এখান থেকে তোরা শিক্ষা নে।
সূত্র জানিয়েছে, হত্যার শিকার ওই পাঁচজনও এক সময় আরসার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আতা উল্লাহ জুনুনি মিয়ানমার সরকারের পক্ষে কাজ করছে-বিষয়টি তারা বুঝতে পারেন।
এরপর আরসার কোনো কর্মকাণ্ডে তারা আর যোগ দিতেন না। বরং সম্প্রতি মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরসার অপকর্মের বিষয়টি সামনে এলে তারা সংগঠনটির অপকাণ্ডের বিষয়ে মুখ খোলেন।
আরসার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সাধারণ রোহিঙ্গাদের অনুপ্রাণিত করছিলেন তারা। এ কারণেই তাদের কৌশলে মিয়ানমারের আরাকানে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর আরসা সম্পর্কে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধারণা পালটে গেছে। তারা বুঝে গেছে আরসা মিয়ানমারের পক্ষে কাজ করে। তাই তাদের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। এ কারণে আরসা এখন মরণ কামড় দিতে চায়।
রোহিঙ্গাদের গ্রুপে আপলোড করা এক অডিওতে বলতে শোনা গেছে, ‘মুহিবুল্লাহ ও মাদ্রাসার ছয় ছাত্র-শিক্ষককে খতলে (হত্যা) নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাসিম। মাস্টার গফুরের কাছে শুনেছিলাম পুলিশের কাছে ধরা পড়ার আগে হাসিমকে মেরে ফেলা হবে। এপারে (রোহিঙ্গা ক্যাম্পে) সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ছিল হাসিম। অন্যদের বাঁচতে হলে তাকে খতল (হত্যা) করতে হবে। আমার কাছেও একই ধরনের রিপোর্ট ছিল।’
রোহিঙ্গাদের আরেক সূত্র জানিয়েছে, যে কোনো সময় উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবির আরও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। আরসার সন্ত্রাসীরা খুনাখুনি করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে ক্যাম্পকে অশান্ত করে মুহিবুল্লাহ ও অন্য হত্যার বিচারের গতি ব্যাহত করতে চায় তারা।
ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম তারিক বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে গণমাধ্যমকর্মীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হাসিমের লাশ উদ্ধার হয়েছে কিনা জানতে চাচ্ছে। তবে এ ধরনের কোনো তথ্য আমরা পাইনি। তারপরও গণমাধ্যমকর্মীদের দেওয়া তথ্যে ক্যাম্প ২১ ও ২২ সহ সব স্থানে খবর নিয়েছি। কোনো লাশ বা ক্যাম্পে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এমন তথ্য এখনো (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) পাওয়া যায়নি।
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায়) যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হাসিম নিহত হয়েছে বলে প্রচার হলেও এখনো তার লাশ খুঁজে পায়নি পুলিশ। তবে, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে সম্ভাব্য সব স্থানে তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মিয়ানমারে আরও ৫ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হওয়ার বিষয়ে এসপি বলেন, অন্য দেশে কি ঘটেছে তা আমাদের গোচর নয়। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতে দুর্বৃত্তরা কথিত সংগঠনের নামে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে সবাই সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে।২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে তার কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এরপর ২৩ অক্টোবর উখিয়ার পালংখালীর ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় আরও ছয়জনকে। এ দুই হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত ২৩ জন সন্দেহভাজন আসামি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মাঝে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তিনজন এবং ছয় খুনের ঘটনায় একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
E-mil: dailyalokito71sangbad@gmail.com
@বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোক চিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বে-আইনি।
Copyright © 2024 alokito71sangbad. All rights reserved.