• আন্তর্জাতিক

    অনেক দিক থেকেই ভুটান ঈর্ষণীয় দেশ

      প্রতিনিধি ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৪:৫২:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    নিউজ ডেক্সঃ

    করোনা এখন আর খুব বড় আলোচনার বিষয় নয়। তাই পত্রিকার পাতার মতামত অংশে লেখার বিষয় হিসাবে করোনা এখন খুব বেশি গুরুত্ব দাবি করে না। কিন্তু একটি সংবাদ আমাকে বর্তমানের করোনা পরিস্থিতির প্রতি কিছুটা দৃষ্টি ফেরালো এবং বিশেষ করে অতীতের করোনা পরিস্থিতির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসব। এ মুহূর্তেই করোনার একটি ঢেউ চলছে বাংলাদেশে। খুব বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা না হলেও বলা যায়, এটি করোনার সর্বশেষ ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন দিয়ে ঘটছে। টেস্টের তুলনায় পজিটিভ পাওয়ার অনুপাত ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বে করোনার যে পরিস্থিতি বাংলাদেশেও একই রকম বলা যায়।

    ওমিক্রনের ভিরুলেন্স আগের যে কোনো সেরোটাইপের তুলনায় অনেক বেশি, অর্থাৎ এটি মানুষকে অনেক দ্রুত আক্রান্ত করতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য এ ভ্যারিয়েন্ট একটা আশাও তৈরি করেছে, আক্রান্তের তুলনায় গুরুতর অসুস্থ হওয়ার হার এ ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অনেক কম। আক্রান্ত রোগীদের খুব অল্পসংখ্যককেই হাসপাতালে যেতে হয় এবং সেখানে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে অনেক কম। বৈশ্বিক করোনার এমন পরিস্থিতিতেই ভুটানে করোনায় চতুর্থ মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। দেশটির জনসংখ্যা যেহেতু এক মিলিয়নেরও বেশ খানিকটা কম (৮ লাখ); তাই এ মৃত্যুর হারকে মিলিয়নে কনভার্ট করলে হয় পাঁচ। এত অকল্পনীয় পরিমাণ কম মৃত্যুর দেশে সর্বশেষ মৃত্যুটি নিয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং কী বলেছেন সেটি একটু দেখে নেওয়া যাক। মৃত্যুটির পর ফেসবুক পোস্টে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনায় আরও একটি মূল্যবান জীবন হারিয়েছি আমরা। এটি আমার কাছে বুলেটের আঘাতের মতো মনে হয়েছিল। আমি জাতির সঙ্গে শোক প্রকাশ করছি। আমাদের প্রিয় বন্ধুর জন্য প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছি।’ একই ঘটনায় টুইট বার্তায় লোটে শেরিং যা বলেন, সেটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরও কাজ করা দরকার ছিল। এ সপ্তাহে করোনায় মৃত্যু একটি ‘তিক্ত স্মৃতি’। আমাদের আরও কিছু করতে হবে।’’

    ভুটানের মাথাপিছু আয় তিন হাজার একশ ডলার, যা বাংলাদেশ সরকারের দাবিকৃত বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। বৈশ্বিক অবস্থানে আয়ের দিক থেকে অনেক নিচুতে থাকা দেশটি করোনা মোকাবিলায় এক অবিশ্বাস্য পারদর্শিতা দেখিয়েছে। আমরা যখন আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় আর সব দেশের তুলনায় করোনা টিকা দেওয়ায় পিছিয়ে রয়েছি, তখন ভুটান তার সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পূর্ণাঙ্গ (দুই ডোজ) টিকা দেওয়া শেষ করেছে। শুধু সেটাই নয়, করোনার পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভুটান স্থাপন করেছে এক অবিশ্বাস্য মাইলফলক। ভুটানে যত করোনা টেস্ট করা হয়েছে, সেটাকে প্রতি ১০ লাখ মানুষের হিসাবে কনভার্ট করলে হয় ১৯ লাখ ১৪ হাজারের বেশি টেস্ট। অর্থাৎ গড়ে নাগরিকপ্রতি দুটি টেস্ট করেছে ভুটান। তাদের এ দেশটার পরিস্থিতি বোঝার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা যাক। প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য বাংলাদেশ করেছে ৭৫ হাজারের কিছু বেশি টেস্ট। অর্থাৎ ভুটান আমাদের তুলনায় টেস্ট করেছে ২৫ গুণ। প্রতি ১০ লাখে পাঁচজনের মৃত্যুর বিপরীতে বাংলাদেশ এ সংখ্যা ১৭০। যদিও যৌক্তিকভাবেই আমরা জানি, বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা এ সংখ্যাটির কয়েক গুণ হবে।

    করোনা নিয়ে শুরু থেকেই সরকারের কার্যক্রম বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের মানদণ্ডে যেমন হওয়ার কথা তা ছিল না। করোনা মোকাবিলায় আর্থিক বরাদ্দের অভাব ছিল। সেই সঙ্গে করোনা হয়েছিল চরম ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা আর অযোগ্যতার সাক্ষী। প্রথম ঢেউ চলে যাওয়ার পরও আমরা দেখেছি হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ দূরে থাকুক, ছিল না অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাও। মৃত্যুর একটা বড় অংশ হয়েছিল চিকিৎসার অভাবে। লকডাউনের সময় খেটে খাওয়া মানুষের বীভৎস দুর্দশা আমরা দেখেছি, কারণ সেসব মানুষের জন্য ন্যূনতম খাদ্য এবং অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়নি।

    এমন সময়ে বাংলাদেশের সরকার তার নাগরিকদের করোনার অসুস্থতা থেকে, করোনা-দারিদ্র্য থেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জরুরি পদক্ষেপ নেয়নি, যখন দেশটির সরকার নিজেদের উন্নয়নের রোল মডেল বলে দাবি করেছে। যৌক্তিক বাজেটের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ের কিছু প্রকল্প দেখিয়ে সরকার এ দাবি করে গেছে সবসময়। পুরো ঘটনার সময়টা সরকার নানামুখী সমালোচনায় পড়েছিল। এ সমালোচনা এসেছে বিরোধী দলগুলোর দিক থেকে তো বটেই, নাগরিক সমাজও নানা ইস্যুতে সমালোচনামুখর হয়েছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে এমন কিছু মানুষও সরকারের করোনা ব্যবস্থাপনার নানা দিকের সমালোচনা করেছিলেন, যারা সরকারেরই গঠিত করোনা মোকাবিলার কমিটিগুলোর সদস্য ছিলেন।

    ওদিকে করোনা মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরও একটি মৃত্যু কাঁপিয়ে দেয় ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে। বুকে বুলেটের আঘাত পাওয়ার মতো কষ্ট নিয়ে তিনি স্বীকার করেন মহামারি মোকাবিলায় তাদের আরও চেষ্টা করা উচিত ছিল। অতি দীর্ঘকালীন গণতন্ত্রের চর্চা করা ইউরোপ-আমেরিকা নয়, পৃথিবীর নবীনতম গণতন্ত্রের একটি দেশ-ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য এটা-ভালোভাবে না জানলে তো অনেকের বিশ্বাসই হতো না।

    আমরা না জানলে অনেকের কাছে এটি অবিশ্বাস্য লাগবে, আমাদের চেয়ে সামান্য বেশি মাথাপিছু আয়-এর ভুটান তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেয়। ভুটানে প্রতিটি নাগরিকের ওষুধসহ সব রকম চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে রাষ্ট্র। আমাদের অনেকের চোখ কপালে উঠবে এটি জেনে, এমনকি কোনো নাগরিকের যদি বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, সেই খরচও রাষ্ট্রই বহন করে। আর বাংলাদেশের চাঁদপুরে এই তো সেদিন একজন শ্রমিকের স্ত্রী হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর হাসপাতালের ২৬ হাজার টাকা বিল দিতে না পেরে শিশুকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় অন্তত ৬৫ লাখ মানুষ।
    ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন বাংলাদেশ

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ