প্রতিনিধি ১৪ জানুয়ারি ২০২১ , ৯:২৪:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ
সাংবাদিকতার অবস্থা এখন কেমন?
শিহাব অাহম্মেদ-সাংবাদিকতা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
DA71S: কী অর্থে?
শিহাব অাহম্মেদ-স্বাধীনতা চর্চার দিক থেকে সাংবাদিকতা এখন সারা বিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন আমরা জানি আমেরিকা স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ হিসেবে সুপরিচিত। সে দেশে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মতো একটা অনন্য বিধান আছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সেই দেশেই এখন প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় সাংবাদিকদের বকাঝকা করেন। সংবাদমাধ্যমে যা কিছু তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়।
তাকেই তিনি ফেক নিউজ বলেন। তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের নিকৃষ্টতম জীবদের অন্যতম বলছেন। এভাবে সাংবাদিকদের ও সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় করা হচ্ছে। শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমা দেশগুলো ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থস্থান; তাদের সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার চর্চা থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের সাংবাদিকেরা অনুপ্রাণিত হতাম। সেটা এখন সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
DA71S:স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি ক্ষমতাধরদের দিক থেকে চ্যালেঞ্জ তো সব সময়ই কমবেশি ছিল।
শিহাব অাহম্মেদ- এখন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে দেশে দেশে অত্যন্ত কঠোর আইন–বিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটা একটা বৈশ্বিক প্রবণতা। আরও এক দিক থেকে সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেটা ঘটেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার ফলে একজন পাঠকের সামনে সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত হয়েছে। সে এখন আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলছে। শুধু জেনে ফেলছে না, সে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের অভিমত দেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। খবরের কাগজের পাঠকের সেই সুযোগ ছিল না।
তাকে সম্পাদক বরাবর চিঠি লিখতে হতো, সেই চিঠি ছাপা হতো কি হতো না, হলে কদিন পরে ছাপা হতো ইত্যাদি অনেক সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন যার হাতেই একটা স্মার্টফোন আছে, সে তার মতামত প্রকাশ করতে পারছে এবং তার মতামত একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সর্বসাধারণের মতপ্রকাশের এত ব্যাপক স্বাধীনতা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ছিল না।
DA71S: এটাকে আপনি সাংবাদিকতার জন্য চ্যালেঞ্জ বলতে চাইছেন কেন?
শিহাব অাহম্মেদ- কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপকতার তুলনায় একটা সংবাদপত্র, একটা টিভি চ্যানেল বা একটা অনলাইন নিউজপোর্টালের অভিগম্যতা অত্যন্ত সীমিত। নাগরিক পর্যায়ে তথ্য আদান–প্রদান ও মতপ্রকাশের এমন স্বাধীনতা ও তার এত ব্যাপকতা সাংবাদিকতার ইতিহাসে কোনো সময়ই ছিল না; এমনকি সভ্যতার ইতিহাসেই ছিল না।
DA71S- কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকেরা তো সাংবাদিকদের বিকল্প ভূমিকা পালন করতে পারে না। মানে, আমি বলতে চাইছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেশাদার সাংবাদিকতার বিকল্প হতে পারবে না।
শিহাব অাহম্মেদ- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা বড় দুর্বলতা হলো, সেখানে যেসব খবরাখবর আদান–প্রদান হয়, সেগুলোর সত্য–মিথ্যা যাচাই–বাছাই করা হয় না, সেগুলো অসম্পাদিত। কিছু বলায় বাছবিচার নেই, যার যা খুশি তাই বলে দিচ্ছে। এবং মিথ্যা কথাও বলছে, নিজেদের মনগড়া কথা বলছে; কাউকে হেয় করার জন্য বা বিপদে ফেলার জন্য বলছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন কদিন আগেই আমরা ভোলায় দেখলাম; তার আগে দেখেছি রামুতে। এভাবে আমরা দেখছি যে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়ের মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছে।
অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নেই, যা পেশাদার সাংবাদিকতার আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে ব্যাপক স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি, সেই তুলনায় এর দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বিরাট। সাংবাদিকতায় যেটাকে বলা হয় এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা নেই। ফলে এই মাধ্যমে খবর আদান–প্রদানের অভিজ্ঞতায় লোকজন আস্থার সংকটে ভোগে। ভাবে যে, আমি যে খবরটা পেলাম, এটা ঠিক না বেঠিক; এটা গুজব বা ফেক নিউজ কি না।
ফেক নিউজ তো শুধু নাগরিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, সংঘবদ্ধভাবেও তৈরি করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে।২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনের সময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে রুশরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিল কি না, তা নিয়ে অনেক তর্ক–বিতর্ক হয়েছে; তদন্ত হয়েছে।
আমেরিকানরা এখন নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে রাশিয়া একটা ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এখানে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা চলে আসছে। এসব কারণে প্রথাগত সাংবাদিকতার ওপরই লোকজনের আস্থা আবার ফিরে আসছে। তারা ফেসবুকে কোনো সংবাদ পেলেই তা বিশ্বাস করছে না, সেটা যাচাই করার জন্য কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কাছে ফিরে আসছে।
দেখি তো প্রথম আলো কী বলছে, ডেইলি স্টার কী বলছে, বা অন্য কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠান কী বলছে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হয়ে যাচ্ছে খবর সত্যায়ন করার জায়গা। কোটি কোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে, সে তুলনায় প্রথাগত সাংবাদিকতার পরিধি অতি সামান্য। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আস্থার সংকট বিরাট।
আপনি বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার সামনে দুই ক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। এটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অন্যটা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে। আর কোনো চ্যালেঞ্জ? তৃতীয় একটা বৈশ্বিক প্রবণতা আছে। সেটা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন তথ্য আদান–প্রদানের সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভোলা ও রামুর মতো ঘটনা যখন ঘটতে পারছে, যা বিদেশেও ঘটছে, তখন তো একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এটার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এটার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার অত্যন্ত কঠোর আইনকানুন তৈরি করছে, কিছু কিছু দেশে প্রয়োগও করছে। তার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এটা একটা বৈশ্বিক প্রবণতা; অনেক দেশ এটা করছে। কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় এ রকম আইনের প্রতিবাদে সে দেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সাদা রেখে ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ সাংবাদিকতার ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ হচ্ছে এবং প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ নিয়ে কঠোর কালাকানুন তৈরি করা হচ্ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কঠিন করে তুলছে।