প্রতিনিধি ১৯ আগস্ট ২০২৩ , ৮:১৩:১৩ প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুল ইসলাম কারীমী-স্টাফ রিপোর্টারঃ
মুহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। এখানেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেল মাদরাসা ছাত্র ওমর বিন সাইফ। মুহাম্মদপুরের স্বনামধন্য মহিলা মাদরাসা ফাতিমাতুজ জাহরা রাযি. মাদরাসার মুহতামিম মুফতি সাইফুল ইসলাম সন্তানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে কেঁদেই চলেছেন। পরিবারের সদস্যদের কান্না যেন থামছেই না। প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন কেউ ছোট্ট ওমরের চলে যাওয়া মানতে পারছে না। শুক্রবার রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ওমরের মৃত্যু ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। শনিবার সকাল ১১ টায় মুহাম্মাদীয়া হাউজিং মেইনরোডে অবস্থিত মুহাম্মাদী আশরাফুল মাদারিস প্রাঙ্গণে জানাজা নামাজ শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
রাজধানীর মোহাম্মাদিয়া হাউজিংয়ে মাদরাসায়ে তাকরিমুল কোরআন ওয়া সুন্নাহর হিফজ বিভাগের নিয়মিত শিক্ষার্থী ১১ পারা কুরআনের হাফেজ ছিল ছোট্ট ওমর। স্বজনদের দাবি, রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ওমর বিন সাইফকে স্থানান্তর করা হয় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের পিআইসিইউ বিভাগে। স্বজনরা জানান, রাত ৯টা পর্যন্তও কোনো জটিলতা ছিল না শিশুর। কিন্তু মধ্যরাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। রাতের শিফটের ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় ওমর মারা যায় বলে অভিযোগ তাদের। এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে পরিবার।
ওমরের বাবা মুফতি সাইফুল ইসলাম বলেন, নার্সের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার ছেলের পালস কত আছে। মেশিনে দেখিয়েছে, ৭৯ থেকে ৮০ পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এই অবস্থা দেখে আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছি। দায়িত্বরত ডাক্তার আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোন টান দিয়ে নিয়ে যায়। বলে ফোনটা আমার কাছে জমা দেন। সকালে নিয়ে যাবেন। এখানে ফোন ব্যবহার করা যাবে না। আমাকে ধমক দিয়ে বের করে দেয়া হয়। চিকিৎসায় অবহেলা ছিল বলছেন ওমরের বাবা মুফতি সাইফুল ইসলাম।
ছোট সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ওমরের মা ফারহানা ইসলাম জানান, আইসিইউতে দেখতে গেলে খারাপ ব্যবহার করে মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়। বার বার অনুরোধের পরও ডাকা হয়নি সিনিয়র চিকিৎসককে। তিনি বলেন, ডাক্তার আমাকে যাওয়ার সময় বলে দিয়ে গেছে, লেভেলটা বাড়ছে। তাই আর কোনো ভয় নেই। আমার ছেলের রিপোর্ট আসেনি। এর মধ্যে নার্স একটা ইনজেকশন দিয়েছে। নার্সের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কীসের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তখন তিনি জানান, এটা তার জানা নেই। এটা ডাক্তার জানেন। আমার ছেলে বলে, স্যার, ‘একটু পানি দেন আমাকে। আপনার পায়ে ধরি।’ কিন্তু তাকে পানি দেয়া হয়নি। পানি ছাড়া আমার ছেলেটা মারা গেল।
নিহত শিশুর বড় ভাই উবাদা বিন সাইফ কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে বাবার প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন। তিনি শুক্রবার দুপুরে তার ফেসবুকে নিজস্ব একাউন্টে পোস্ট দেয় ‘আমার ছোট ভাইটার জন্য সবাই খাস ভাবে দু’আ করবেন, গতকাল থেকে হসপিটালে ভর্তি, কেবিনেই ছিলো কিন্তু আজ, অবস্থার অবনতি হওয়াতে দুপুর থেকে পি.আই.সি.ইউতে আছে। তবে রাতে ফেসবুক লাইভে এসে ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনার আদ্যোপ্রান্ত তুলে ধরেন। এর পরই হাসপাতালে মিডিয়া ও প্রসাশন উপস্থিত হয়। এদিকে দায়িত্বরত চিকিৎসকের দাবি, রোগীর চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি হয়নি। যদিও এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন নিহতের বড়ভাই মাদরাসা শিক্ষার্থী মাওলানা উবাদা বিন সাইফ। তিনি বলেন, ‘এ হাসপাতালে শুধু আমরাই নয়, আমাদের মতো অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে। আমরা যদি বিষয়টিকে এভাবে ছেড়ে দেই, তবে ভবিষ্যতে আমার ভাইয়ের মতো আরও অনেক শিশু প্রাণ হারাতে পারে।’হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করবেন জানিয়ে উবাদা বলেন, ‘আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ঘটনাসহ হাসপাতালের ইতিপূর্বের সকল অভিযোগ আমলে এনে প্রশাসন যেন সুষ্ঠ তদন্ত করে এ বিষয়ে দাবি জানাব। ’
তবে অভিযোগ প্রত্যাখান করে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল তানিম বলেন, ‘প্রেসার কম থাকায় আমাদের যা যা প্রয়োজন ছিল, সবই করেছি। চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি ছিল না।’এদিকে এ ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তাপ-উত্তেজনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে মাদরাসা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। বিষয়টির সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের দাবি করছেন তারা।